Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয়১

ঐশ্বর্যময়ী

প্রশ্ন উঠিতে পারে, ইহাই কি নারীশক্তির নমুনা? কেনই বা ওই তরুণী বধূ অসম্মানিত, বিতাড়িত হইয়াও শ্বশুরগৃহে ফিরিতে এত আগ্রহী? ঐশ্বর্যও এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পৌত্রী, তাঁহার পিতা বিহারের বিধায়ক। প্রভাবশালী, সম্পন্ন পরিবারের উচ্চশিক্ষিতা কন্যার এত অবমাননা সহিয়া স্বামীগৃহে থাকিবার প্রয়োজন কী?

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০২:০০
Share: Save:

ঋগ্বেদের দেবীসূক্তে নিজের স্বরূপ বর্ণনা করিয়া ভগবতী বলিয়াছেন, ‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং’ —আমি জগতের ঈশ্বরী, সকল সম্পদ আমিই প্রদান করি। সেই দেবী যখন আরাধ্য দুর্গাদেবী রূপে কল্পিত হন, তখন তাঁহার নিজস্ব একখানি বাসগৃহ পর্যন্ত তাঁহার মনুষ্যভক্তরা কল্পনায় আনিতে পারেন না। শিব স্বয়ম্ভু, তাঁহার পিতার নাম কুত্রাপি উল্লিখিত নাই, তথাপি দুর্গাকে ‘শ্বশুরবাড়ি’ থাকিতে হয়। কোনও চিত্রকল্পে তিনি চিরযোগী মহেশ্বরের সহিত ভস্মাচ্ছাদিত দেহে শ্মশানে ঘুরিয়া বেড়ান, নচেৎ তুষারাবৃত পর্বতশিখরে তাঁহার অলৌকিক ঘরকন্না করিয়া থাকেন। বৎসরে চারিটি দিন তাঁহার স্থান হয় পিতার গৃহে। এই লোকায়ত চিত্রে দেবীর স্বরূপ অপেক্ষা তাঁহাদের ভক্তদের মনটিই প্রকাশ পায় অধিক। একটি মেয়ের শক্তি বা সম্পদ যতই হউক, তাহার স্বতন্ত্র আবাস, স্বেচ্ছা জীবনযাপন ভারতীয়রা কল্পনায় আনিতে পারেন না। এই জন্যই দেবীর শক্তির আরাধনায় ভক্তের উচ্ছ্বাসের সহিত মেয়েদের প্রতি পরিকল্পিত বঞ্চনা এ দেশে এত দিন পাশাপাশি চলিতে পারিয়াছে। যাহা দেবীরও নাই, তাহা মানবী কী প্রকারে দাবি করিতে পারে? সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আর্থিক সম্পদ যেমনই হউক, কেবল মেয়ে বলিয়া তাহাকে অপমানিত হইতে হয়। দেবীপক্ষের সূচনায় বিহারের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এবং রাবড়ি দেবীর গৃহে তাঁহাদের পুত্রবধূ ঐশ্বর্যর যে অবমাননা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাইল, তাহা জাতির লজ্জা। শ্বশুরগৃহ হইতে বধূ বহিষ্কৃত হইলেন, রাত্রির অন্ধকারে গৃহপ্রাঙ্গণে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পুলিশের হস্তক্ষেপে গৃহে প্রবেশ করিলেন। বধূর প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা ভারতীয় সমাজে এত সুলভ বলিয়াই এই ঘটনাটি জনমানসে এমন বেদনার সঞ্চার করিয়াছে।

প্রশ্ন উঠিতে পারে, ইহাই কি নারীশক্তির নমুনা? কেনই বা ওই তরুণী বধূ অসম্মানিত, বিতাড়িত হইয়াও শ্বশুরগৃহে ফিরিতে এত আগ্রহী? ঐশ্বর্যও এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পৌত্রী, তাঁহার পিতা বিহারের বিধায়ক। প্রভাবশালী, সম্পন্ন পরিবারের উচ্চশিক্ষিতা কন্যার এত অবমাননা সহিয়া স্বামীগৃহে থাকিবার প্রয়োজন কী? লালুপ্রসাদের পরিবারের অভিযোগ, তাঁহাদের দুর্নাম করিতেই বধূ এমন কারসাজি করিতেছেন। সত্যতা বিচার সম্ভব নহে, তাহার প্রয়োজনও নাই। বাস্তব ইহাই যে, বহু উচ্চশিক্ষিতা, উপার্জনরত মহিলারও নির্যাতন ও অপমানের জীবন হইতে সরিয়া আসিবার শক্তি নাই। নিজস্ব গৃহ না থাকিবার সমস্যা তাহাদের পথ রোধ করিয়া দাঁড়ায়। বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে পিতৃগৃহে সে পরবাসী হইয়া যায়, শ্বশুরগৃহে সে বসবাসের অধিকারটুকুই কেবল পায়। কেরলে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পাইয়াছিল যে, নিজগৃহ থাকিলে বধূনির্যাতনের হার অনেক কমিয়া আসে। কিন্তু পরিবার মেয়েদের বঞ্চনা করিয়া থাকে। আবার ইহাও সত্য যে, পিতৃগৃহের সহিত সুসম্পর্ক বজায় রাখিতে, পূজার সময়ে সন্তান-সহ বাপের বাড়িতে আসিবার পথটি খোলা রাখিতে বহু মেয়ে তাহার আইনি দাবি ছাড়িয়া দেয়।

মেয়েদের আত্মবঞ্চনা সর্বদাই সমাজে অধিক প্রশংসিত হইয়া থাকে। মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করিয়া স্বর্গ জয় করিয়াও তাহা শাসন করেন নাই, দেবতাদের দান করিয়া অন্তর্হিত হইয়াছিলেন। তাঁহার কন্যারাও সর্বশক্তিতে স্বামী-সন্তানের স্বার্থের সুরক্ষা করিতে যুদ্ধ চালাইয়া যায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না। তাই বৃদ্ধা মাতা কিংবা তরুণী বধূ নিত্যই গৃহ হইতে বিতাড়িত হইতেছেন। যে বাংলায় মা দুর্গার পূজায় এত আড়ম্বর, সেই বাংলার বিধবারাই বৃন্দাবনের আশ্রম, মন্দির, পথে ভিক্ষা করিতেছেন। শ্বশুরগৃহের বন্ধ দরজার সম্মুখে বসিয়া কত বিপন্ন বধূ। যে দেবী জীবের অন্তরে বিবেকদীপ প্রজ্বলিত করেন, তাঁহার উপাসনা কি এই ভ্রান্তবুদ্ধি বিনাশ করিবে না?

অন্য বিষয়গুলি:

Lalu Prasad Yadav Aishwarya Rai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy