কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটি।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়—বাংলায় নবজাগরণ প্রক্রিয়া তখন তুঙ্গে। কিছু মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ নবজাগরণের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে হেঁটে চলেছেন। বাংলা যেন পুনর্জন্ম উপলব্ধি করছে। বাংলায় তখন ঔপনিবেশিক শাসন চলছে। কিন্তু তার মধ্যেও রামমোহন, বিদ্যাসাগরেরা একাগ্র চিত্তে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে রত। এমতাবস্থায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নদিয়ারাজের ক্ষমতাকেন্দ্র কৃষ্ণনগরে এলেন। না, জমিদারির কাজের নয়, সে এক অন্য কাজ! ব্রাহ্মধর্ম বিস্তারের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন কি না!
যা-ই হোক, ভণিতা না করে বলেই ফেলা ভাল যে, হঠাৎ করে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ হেন কৃষ্ণনগরে আগমনের পশ্চাতে প্রধান কারণ ছিল—কৃষ্ণনগরে নবনির্মিত ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের উদ্বোধন করা। বিভিন্ন সময়ে নদিয়ারাজের যে সকল রাজধানী ছিল, তার মধ্যে কৃষ্ণনগর অন্যতম। আর সে কারণেই এখানে বেশকিছু পুরাকীর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটি।
কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপনের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করার দিকে সরকারের কোনও নজর নেই, বরং তাকে যেমন তেমন করে ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতে পারলে সে খুশি। কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারের ক্ষেত্রে সেটি দেখা যায়। হেরিটেজ বলে ঘোষিত কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটি প্রায় ১৭২ বছরের পুরনো। সৌধটির গায়ে কোনও প্রতিষ্ঠা দিবস বা বর্ষের উল্লেখ নেই। তবে নদিয়ারাজের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের ‘ক্ষিতীশবংশাবলী চরিত’ অনুসারে ১৭৬৯ শকাব্দে অর্থাৎ ১৮৪৭ প্রচলিত অব্দে আমিনবাজার স্থিত কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ ছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। তাঁর উত্তরপুরুষ শ্রীশচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণনগরে প্রথম ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথমে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণেই ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু রাজা মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ায় তিনি ব্রাহ্মদের রাজবাড়িতে সমাজ করতে নিষেধ করেন। তখন ব্রাহ্মেরা আমিনবাজারে একটি ছোট ভাড়া বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় কিছু দিনের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব সামলেছিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে একজন বেদবত্তা ব্রাহ্ম উপাচার্য প্রেরণ করেন।
ক্রমে কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মধর্মের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথের আনুকূল্যে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের বর্তমান ভবনটি নির্মিত হয়। এই ভবনটি উদ্বোধন করতে মহর্ষি স্বয়ং কৃষ্ণনগরে আসেন। ভবনটি নির্মাণের জন্য তিনি এক হাজার টাকা প্রদান করেছিলেন বলেও জানা যায়। আজ সেই ভবনের ভগ্ন দশা।
শুধু কৃষ্ণনগরেই নয়, এক সময়ে সমগ্র নদিয়া জেলাতেই বেশ কিছু ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জেলার একটি প্রাচীন শহর শান্তিপুরে ১৩০৪ বঙ্গাব্দে ব্রাহ্মসমাজ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিপুর ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অতঃপর এর সঙ্গে যুক্ত হন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এবং অঘোরনাথ রায় গুপ্ত। প্রথমে বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন বসত। তারপর বীরেশ্বর প্রামাণিক মহাশয় সম্পাদক থাকা কালে চাঁদা তুলে ১৩০৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে শান্তিপুর ব্রাহ্মসমাজের নিজস্ব ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের বর্তমান ভবনটির সম্মুখ ভাগে সাতটি দরজা দেখতে পাওয়া যায়। মাঝের দরজাটির প্রায় এক ফুট উপরে বর্গক্ষেত্রাকারে একটি প্রস্তর ফলকে এখনো ইংরেজি হরফে ‘BRAHMOSAMAJ KRISHNAGAR’ এবং বাংলা হরফে ‘কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ’ লেখাটি কষ্ট করে হলেও উদ্ধার করা যায়। ২০১১ সালের ২৩শে মে ওয়েস্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন এটিকে হেরিটেজ সৌধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু হেরিটেজ ঘোষণার পরেও এই ভবনটি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ভগ্নস্তূপ হিসেবেই পড়েছিল। সংস্কার কিছুই হয়নি। তার পরে অবশ্য কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মঞ্চের পক্ষ থেকে ডাক্তার সুব্রত পালের নেতৃত্বে কৃষ্ণনগর পুরসভার নজরে বিষয়টি আনা হয়। তাতে একটু আশার আলো দেখা যায়। এ বার হয়তো ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটির সঠিক পরিচর্যা হবে। কিন্তু এ কি? একটি হেরিটেজ স্মারককে এমন ভাবে সংস্কার করা হয় যে, পুরনো ব্রাহ্মসমাজের ভোল পাল্টে যায়। ইতিহাসের অনেক সাক্ষ্য লুপ্ত হয়।
এ রাজ্যের অন্যতম পুরাতন পুরসভা হল কৃষ্ণনগর পুরসভা (স্থাপিত ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ)। পাঁচ বছর আগেই কৃষ্ণনগর পুরসভার সার্ধ শতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে। সে দিক থেকে এটিও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ এবং কৃষ্ণনগর পুরসভা প্রায় পিঠোপিঠি বলা যায়। সম্প্রতি পুরসভার উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজের সামনের ঝোপঝাড় পরিষ্কার হয়েছে। উঠোন বাঁধানো হয়েছে। একাধিক পুরনো গাছ কাটা পড়েছে। এখন মন্দির প্রাঙ্গণে মোটে চারটি বৃহৎ গাছ টিকে রয়েছে। ব্রাহ্মসমাজের চারপাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সেই প্রাচীরের সংস্কার না করে ভেঙে ফেলা হয়েছে। কেবলমাত্র ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের পিছনের প্রাচীরটি রয়ে গেছে। ব্রাহ্মসমাজের সামনে আর এন টেগোর রোডের দিকে এখন পুরসভা ইস্পাতের বেড়া দিয়েছে।
তবে এ বার আমরাই কি বলব— বাঙালির কোন ইতিহাসচেতনা নেই? নাকি বলব— বাঙালির ইতিহাস থাকলেও সে তার ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে জানে না?
লেখক শিক্ষক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy