শান্তিনিকেতনের গোয়ালপাড়ায় কোপাই নদীতে চলছে মাছ ধরা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
নদীমাতৃক দেশ ভারত। নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই। নদীকে কেন্দ্র করেই সভ্যতার বিকাশ। মানুষের স্থায়ী বসবাসের সূত্রপাত নদীর ধারে। আফ্রিকার হাড্ডার অঞ্চলে কাডগোনা নদীর তীরে বসবাস করা মানুষই প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানবজাতি। মিশরের নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতার কথা সুবিদিত। আদি অনন্তকাল ধরে নদ-নদীই যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা বানিজ্য, জনবসতি স্থাপন, সেচ ব্যবস্থার বিকাশের প্রধান ভূমিকা নেয়। নদীর সঙ্গে তাই মানুষের সম্পর্ক নিবিড় ও আত্মিক। নদীকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের কথা সুবিদিত। এক কথায় অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে নদীর ভূমিকা অসীম।
বীরভূম জেলার উল্লেখযোগ্য নদ-নদীগুলি হল ব্রাহ্মণী, অজয়, হিংলো, কোপাই, দ্বারকা, বক্রেশ্বর ও ময়ূরাক্ষী। রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে কোপাইয়ের সম্পর্ক সকলেরই জানা। বীরভূম জেলার উত্তরে বক্রেশ্বর ও দক্ষিণে অজয় নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলেছে কোপাই।
ঝাড়খণ্ডে জামতারা জেলার খাজুড়ি গ্রামে উৎপত্তি হয়ে দুবরাজপুর, খয়রাশোল, ইলামবাজার, লাভপুর থানার ২৩০টি গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে কোপাই। উৎস থেকে প্রবাহিত হওয়ার পরেই নদীর পরিচিতি ‘শাল’ নামে। বোলপুরের বিনুরিয়া গ্রামের কাছে নদীর নাম বদলে হয়েছে কোপাই। কিন্তু কোপাই নামেই এই নদী পরিচিত। এই নদী বীরভূমের বৃহৎ অংশের মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। নানা ঋতুতে এই নদীর নানা রূপ। বারোমাসে এই নদীর বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। —
আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর-ভর-
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।”
লাভপুর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে পাথরঘাটা গ্রামের কাছে বক্রেশ্বর নদীর সঙ্গে মিশেছে কোপাই। এই নদীর অববাহিকার মোট আয়তন ৪৩৬ বর্গ কিলোমিটার। কোপাই নদীর উপত্যকায় সুপ্রাচীন মাইক্রোলিথ স্ফটিক পাথর ও প্রস্তুরীভূত কাঠ পাওয়া গিয়েছে। নদী অববাহিকার মাটির রঙ লাল। এই মাটিতে ভূমিক্ষয়ের ফলে ছোট ছোট খাত তৈরি হয়েছে। সেগুলি খোয়াই নামে পরিচিত। সেই কারণে খোয়াই যেন কোপাই-এর জীবন পথের পথিক। কিন্তু নগর সভ্যতার থাবায় প্রকৃতির উপর নরম আলপনার এই খোয়াই আজ বিলুপ্তির পথে।
মানব জীবনের মতোই নদীরও শিশুকাল থাকে, যৌবন ও বার্দ্ধক্য আসে, জরা গ্রাস করে। পাড় ভাঙে, গতিপথ পাল্টায়, পলিস্তর নদীর বুক ভরাট করে। নদী নাব্যতা হারায়। বহমান নদীতে সেচবাঁধ দেওয়ায় নদীর গতিপথ বাধা পায়, বন্যার প্রকোপ বাড়ে। কোপাই এর ব্যতিক্রম নয়। এইসব নানা কারণে কোপাই বারবার বক্রগতিতে প্রবাহিত হয়েছে। কোপাই-এর এই বক্রগতিই আবার সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠেছে। এই নদীর বাঁকগুলো অনেকটা হাঁসুলি আকৃতির। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস এই বাঁককে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা এক অমরসৃষ্টি। ১৯৬২ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মাণ হয়েছিল। সেলুলয়েডের পর্দা জুড়েও ছিল কোপাইয়ের খাত, জীবন নদীর মতোই বহমান চলন।
কোপাই নদীর সঙ্গে নদী তীরের মানুষের এক নিবিড় সম্পর্কের কথাই বারবার বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে শুরু থেকে। কবি ভাষায়, ‘এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই নদী।’ হয়ত ‘প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার।’ মানুষের সঙ্গে কোপাই-এর আত্মীয়তার বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে / সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে।’ দু’ধারের চাষবাস, প্রকৃতিতেও কোপাই নির্ভরতা দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘শণের খেতে ফুল ধরেছে একেবারে তার গায়ে গায়ে / জেগে উঠেছে কচি কচি ধানের চারা / অদূরে তালগাছ উঠেছে মাঠের মধ্যে, / তীরে আম জাম আমলকির ঘেঁষাঘেঁষি।’
কিন্তু সময়ের ফেরে কবি যে নদীতে ‘কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোত’ দেখেছিলেন, সেই জলধারা আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে। রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্করের প্রতিবেশিনী কোপাই আজ আর ভাল নেই। ক্রমেই শুকিয়ে আসছে নদীখাত। নদীর গতিপথে বহু জায়গায় স্থায়ী বালির চরা পড়েছে। শান্ত কোপাই বর্ষায় বন্যা ডেকে আনে, তাতে বালি জমে নদীবুক আরও অগভীর হয়। আর বাকি সময় শুকনো ধূ-ধূ বালিতে ছোট বড় পাথরের চাঁই বুকে নিয়ে নিঃশব্দে পড়ে থাকে। তখন এর অস্তিত্ব ছোট নালা বা খালের মতো।
কোপাই কেমন আছে জানতে ১৯৯১ এবং ২০১৬ সালে নদী বিশেষজ্ঞ মলয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত দুটি সমীক্ষা হয়। নদীকে বাঁচানোর বার্তা দেওয়া ও নদীর পরিবেশ সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরি করতেই তাঁদের এই কোপাই অভিযান ছিল। সমীক্ষায় জানা যায়, ‘কোপাইয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনুভব করা তীরবর্তী বাসিন্দাদের আত্মীয়তা আর নেই। বরং নদীটির প্রতি অধিকাংশ মানুষের উপেক্ষা আর অনাগ্রহই লিপিবদ্ধ করেছি আমরা। সবচেয়ে বড় বিপদ নদীর পাড়ে গজিয়ে ওঠা যথেচ্ছ ইটভাটা ও পাড় থেকে বালি লুঠ।’ একটি-দু’টি নয়, কোপাইয়ের পাড় বরাবর শয়ে শয়ে ইটভাটা দেখেছেন সমীক্ষকেরা। উৎসস্থল ঝাড়খণ্ডের খাজুড়ি গ্রাম থেকে শুরু করে লোকপুর, বীরভূমের বিনুরিয়া, এমনকি, মোহনায় হাঁসুলি বাঁকের কাছেও ইটভাটা গজিয়ে উঠেছে।
শুধুমাত্র বীরভূম জেলাতেই কোপাই নদীর উপর ২৮টি ইটভাটা তৈরি হয়েছে। এই ইটভাটাগুলির ময়লা, বর্জ্যের অংশবিশেষ নদীকে দূষিত করছে। আবার এর প্রভাব পড়ে জীববৈচিত্রেও। শুধু তাই নয়, যেখানে সেখানে নদীবক্ষে বাঁধ দেওয়ার ফলে কোপাই তার চলার ছন্দ হারিয়েছে। শুকনো নদী খাত থেকে বেআইনিভাবে বালি চুরি চক্র চলছে। নদীর পাড় থেকে মাটি চুরি বা নদীর পাড় দখল করে নেওয়ার মত অভিযোগও বিস্তর। নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখন শুধুই স্বার্থের।
কোপাইকে আবার নিজস্ব ভঙ্গিমায় ঋতুরঙ্গের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে সচেতন হতে হবে নদীপাড়ের সমস্ত মানুষদের। আলোচনা সভা, কোপাই বাঁচাও পদযাত্রার মতো লাগাতার সচেতনতার পদক্ষেপ করতে হবে। বীরভূমের পর্যটন শিল্পের বিকাশের সঙ্গে কোপাইকে একত্র করে পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। কোপাইকে হেরিটেজ নদীর মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। নদীটিকে নিয়ে ভাবনা দরকার। দরকার সচেতনতার। আর দরকার তার দিকে দৃষ্টি ফেরানোর। সকলকে উপলব্ধি করতে হবে নদীও আমাদের দেহের মতোই এই প্রকৃতির শিরা উপশিরা। এগুলি শুকিয়ে গেলে বিপন্ন হবে মানুষ, প্রকৃতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি।
লেখক বিশ্বভারতীর উপ-গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy