Advertisement
E-Paper

হিতৈষী-সংগ্রামী খান রাজারা

রাজাদের সুকীর্তি অক্ষয় হয়। যেমন হয়েছে নাড়াজোলের দুই রাজার কীর্তি। তাঁরা ছিলেন প্রজাদরদি। বিদেশি শাসকের বন্ধন মুক্তির সৈনিক।

দৃঢ়চেতা: রাজা নরেন্দ্রলাল খান। ‘নাড়াজোল এক অনন্য জনপদ’এর পৃষ্ঠা থেকে।

দৃঢ়চেতা: রাজা নরেন্দ্রলাল খান। ‘নাড়াজোল এক অনন্য জনপদ’এর পৃষ্ঠা থেকে।

কিংশুক আইচ

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২০ ০২:৪৯
Share
Save

কথাতেই আছে রাজার হাল। রাজা মানেই জাঁকজমক। সাধারণের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এমন রাজাও বঙ্গদেশে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যাঁকে জেলে পুরেছিল ব্রিটিশরা। যাঁর প্রাসাদকে মেদিনীপুর জেলার সহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের ভরকেন্দ্র বলে মনে করেন অনেক গবেষকই।

তিনি নরেন্দ্রলাল খান। নাড়াজোলের রাজা। পিতা মহেন্দ্রলাল খানের মৃত্যু হয় ১৮৯২ সালে। নরেন্দ্রলাল নাড়াজোলের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি পান। মেদিনীপুরও ছিল তাঁর অধীন। এই বংশের এক পুরুষ উদয়নারায়ণ ঘোষ বর্ধমান থেকে নাড়াজোলে এসে জমিদারি পত্তন করেন। বংশের পঞ্চম পুরুষ কার্তিকরাম বাংলার অধীশ্বর সোলেমান কারবানির কাছ থেকে ‘রায়’ উপাধি পেয়েছিলেন। ১৫৯৬ সালে বলবন্ত রায় বাংলার সুবেদার বা নাজিমের কাছ থেকে খান উপাধি পান। সেই থেকে নাড়াজোলের জমিদাররা খান। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি রানি ভিক্টোরিয়ার জুবিলি উৎসব উপলক্ষে ইংরেজ সরকার মহেন্দ্রলালকে ‘রাজা’ খেতাব দেন। খেতাব ব্যবহারের অনুমতি আসে ১৮৯৫ সালে। তার তিন বছর আগে মহেন্দ্রলাল প্রয়াত হন।

মহেন্দ্রলাল জ্ঞানান্বেষী ছিলেন। সংস্কৃতি চর্চা, সঙ্গীতে উৎসাহ ছিল। ‘সঙ্গীত লহরী’, ‘মানমিলন’, ‘গোবিন্দগীতিকা’, ‘মথুরা মিলন’ ‘শারদোৎসব’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ তাঁর সাহিত্য অনুরাগের সাক্ষ্য দেয়। মেদিনীপুর কলেজে পিতা আযোধ্যারামের নামে বৃত্তি চালু করেছিলেন। অযোধ্যারাম মেদিনীপুর শহরে কুষ্ঠাশ্রম স্থাপন করেন। সেই সময়ে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় কুষ্ঠ এক মারাত্মক ব্যাধি ছিল।

মহত্বের এই উত্তরাধিকার-ই বয়ে ছিলেন নরেন্দ্রলাল। ১৮৬৭ সালে জন্ম তাঁর। ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ‘পরিবাদিনীশিক্ষা’ নামে গানের বই লিখেছিলেন। আবার তাঁর আমলেই জমিদারির আয় কয়েকগুণ বেড়েছিল। কলকাতার ডাফরিন ও মেদিনীপুরের হাসপাতালে তাঁর দানেই অনেক পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। মেদিনীপুর শহরের জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই জল সরবরাহ ব্যবস্থার সূচনা হয় ১৯২৪ সালে। তার আগেই মারা যান নরেন্দ্রলাল। স্টেশন রোডের প্রাচীন জলের ট্যাঙ্কের গায়ের প্রস্তরফলকে লেখা রয়েছে রাজা নরেন্দ্রলাল খান ওয়াটার ওয়ার্কস। শহরে গোপ প্যালেস তাঁর আমলেই নির্মিত।

নরেন্দ্রলাল খান মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও স্থান করে নিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন তিনি। ১৯০২ সালে অরবিন্দ ঘোষ মেদিনীপুরে এসে জেলার যুবকদের স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্ধুদ্ধ করেন। ১৯০৩ সালে আসেন ভগিনী নিবেদিতা। ১৯০৬ সালের ২১ জুলাই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটালের এক জনসভায় বিলিতি দ্রব্য বর্জনের ডাক দেন। এসব সভা যেমন মেদিনীপুরের সাধারণ মানুষকে, বিশেষত যুবকদের স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্ধুদ্ধ করে, তেমনই অভিজাতেরাও প্রভাবিত হন। নরেন্দ্রলালও স্বদেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হন। বিলিতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। ঋষি রাজনারায়ণ বসুর ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো শহরে যে বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্যোগ করেন। তাতেও সক্রিয় অংশ ও অর্থ সাহায্য ছিল নাড়াজোল রাজের। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৬ অক্টোবর মেদিনীপুর, নাড়াজোল-সহ জেলার নানা এলাকায় অশৌচ দিবস পালন করা হয়। তাতে অংশ নিয়েছিলেন নরেন্দ্রলাল। অনেক গবেষকদের মতে, শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু নাড়াজোল রাজবাড়ির তহশিলদার ছিলেন। নানা কারণে তাঁর সম্পত্তি রাজা নিলাম করে দেন। নরেন্দ্রলাল এই সম্পত্তি ক্ষুদিরামকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষুদিরামের তাতে উৎসাহ ছিল না। তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নরেন্দ্রলালের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন। নরেন্দ্রলাল অর্থ সাহায্য করেছিলেন। নাড়াজোল রাজবাড়ির অন্দরে ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। সেখানে চলত অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও বোমা তৈরি। যার প্রধান ছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো। এ ছাড়া অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত-সহ অনেকেই এই আস্তানা থেকে গোপন সভা করতেন। মেদিনীপুর, নাড়াজোল দুই প্রাসাদেই কর্মকাণ্ড চলত।

রাজ পরিবারের সদস্য সন্দীপ খান ও অরিজিৎ খান জানালেন, কিছুদিন আগে নাড়াজোলের প্রাসাদে এক গুপ্ত কক্ষের সন্ধান পেয়েছেন। সিঁড়ির পাশে এমন ভাবে তা তৈরি বোঝা উপায় নেই ভিতরে কোনও ঘর আছে। ঘরে কোনও জানালা নেই। শুধু কয়েকটি ছোট ছোট খুপরি। বংশের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা সন্দীপের ধারণা, এই ঘরে গোপন সভা হত। বিপ্লবীদের লুকিয়ে রাখাও হত। খুপরিগুলি সম্ভবত বাতাস চলাচলের জন্য। মেদিনীপুরের প্রাসাদের চার পাশে সেসময়ে ছিল ঘন জঙ্গল। সেখানেও বিপ্লবীদের সভা হত। হেমচন্দ্র কানুনগো এই প্রাসাদে অনেকদিন লুকিয়ে ছিলেন। বোমা তৈরি শিখতে হেমচন্দ্র ইউরোপ গিয়েছিলেন। তাতে নরেন্দ্রলাল খান ও ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সক্রিয় সাহায্য ছিল। ইতিহাস বলে, সেই সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলন নাড়াজোলের নরেন্দ্রলাল খান, মুগবেড়িয়ার জমিদার দিগম্বর নন্দ আর তমলুকের রাজাদের মদতে পুষ্ট ছিল।

দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশের নজরে ছিলেন রাজা। ১৯০৮ সালের জুলাই মাসে মেদিনীপুর শহরে কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। গ্রেফতারও করা হতে থাকে। একখানি বোমাও নাকি মেলে। বোমাটি তদানীন্তন পুলিশ সুপার ব্রেথ নাকি নিজের রুমালে বেঁধে হাতে করে ঝুলিয়ে নিয়ে যান। বোমা অছিলা মাত্র। সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করাই ছিল উদ্দেশ্য। ২৮ অগস্ট পুলিশ মেদিনীপুর ও নাড়াজোলের প্রাসাদে তল্লাশি চালায়। গ্রেফতার হন নরেন্দ্রলাল। এই মামলা মেদিনীপুর বোমার মামলা নামে পরিচিত। জামিন না মেলায় তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড সেলে বন্দি রাখা হয়। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৭ সেপ্টেম্বর জামিন পান নরেন্দ্রলাল। এরপরেও নরেন্দ্রলালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য কমেনি। ১৯২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

বাবার মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রলাল রাজা হন। তিনি কুমার দেবেন্দ্রলাল নামেই পরিচিত ছিলেন। দেবেন্দ্রলাল ছিলেন বাবার মতোই। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সহায়ক। ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্রের একনিষ্ঠ অনুগামী। শরৎকুমার বসুর ঘনিষ্ট বন্ধু। মেদিনীপুরের ব্যবস্থা পরিষদের সভ্য নির্বাচনে প্রায় ৭০ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। সারা বাংলায় সেটা রেকর্ড ছিল। এই ফলাফল সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন। বাবা বেঁচে থাকার সময়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে তিনি ‘বেঙ্গল লাইট হর্স’ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রলাল ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯২৮ সালে কলকাতায় মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। মতিলাল দেবেন্দ্রলালের বাসভবন থেকে এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। অধিবেশনে নেহরু রিপোর্ট নিয়ে প্রবল বাদানুবাদ হয়। সুভাষচন্দ্র বসু পূর্ণ স্বাধীনতা জন্য আন্দোলনের দাবি তোলেন। দেবেন্দ্রলাল ছিলেন নেতাজির পক্ষে। অনেক পরে নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র অশোকনাথ বসু তাঁর ‘মাই আঙ্কেল নেতাজি’ গ্রন্থে লিখেছেন নেতাজির অত্যন্ত আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন দেবেন্দ্রলাল।

১৯৩০ সালে তিনি সাবেক মেদিনীপুরের জেলা কংগ্রেস সভাপতি হয়েছিলেন। ওই সালেরই ২৬ জানুয়ারি তিনি নাড়াজোল রাজবাড়িতে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই শুরু। সক্রিয় ভাবে যোগ দেন কংগ্রেসের খাজনা বন্ধ আন্দোলনে। ১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গাঁধীজি মেদিনীপুরবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে দেবেন্দ্রলালকে এক বার্তা পাঠান। তিনি লিখেছিলেন, ‘আই টেন্ডার মাই কনগ্রাচুলেশন ফর ইয়োর কারেজ অ্যান্ড পেসেন্স উইথ হুইচ ইউ হ্যাভ বোর্ন ইয়োর সাফারিংস’।

এক সময় ছিল নাড়াজোল রাজবাড়ির অন্দরে তথাকথিত অন্ত্যজদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দেবেন্দ্রলাল অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে ও জাতিভেদ প্রথা অবসানের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। অস্পৃশ্যতা বর্জন সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন। অস্পৃশ্যতা দূরে এক সভায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শারীরিক অসুস্থতার জন্য সভায় না যেতে পারার কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন। ১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল মেদিনীপুরের জেলাশাসক জেমস পেডিকে গুলি করেন বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষ। পরদিন সকালে তিনি মারা যান। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সারা শহরে আনন্দ ও উল্লাসের বন্যা। খবর পেয়ে মেদিনীপুরের গোপ প্যালেসে উৎসবের আয়োজন হয়েছিল বলে লিখেছেন গবেষক হরিসাধন দাস। তাঁর তথ্য অনুসারে, দেবেন্দ্রলাল খান নাকি খুশিতে নেচেও ফেলেন। ১৯৩১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত হিজলি জেল গুলিচালনার ঘটনা ঘটে। তার প্রতিবাদে কলকাতার অক্টোরলনি মনুমেন্টের পাদদেশে প্রতিবাদ সভা হয়। তাতে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজির মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেবেন্দ্রলাল খানও ছিলেন।

মেদিনীপুর ও নাড়াজোলের প্রাসাদে নেতাজি, গাঁধীজি থেকে দেশ ও রাজ্যের সব প্রথম সারির নেতারাই এসেছেন। ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার পর নেতাজি মেদিনীপুরে আসেন। দেবেন্দ্রলাল খানকে নিয়ে তিনি তিনটি সভা করেন। ১৯৪০ সালের ১২ মে ঝাড়গ্রামের জনসভায় ভাষণ দিতে নেতাজি মেদিনীপুরে পৌঁছে গিয়েছিলেন আগের রাতেই। সে রাতে নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খানের অতিথি হয়ে গোপ প্রাসাদে রাত কাটিয়েছিলেন তিনি। পরদিন দেবেন্দ্রলালের সঙ্গে মোটরে চেপে ধেড়ুয়া হয়ে নৌকায় কংসাবতী নদী পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম পৌঁছন নেতাজি।

দেবেন্দ্রলালের মৃত্যুর বছর নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে একটি সূত্র মতে, তিনি ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পেরেছিলেন। এই সূত্র মতে, তাঁর মৃত্যু ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৪ পৌষ।

Independence King

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}