গোখরো। ফাইল ছবি
মহাভারতের শুরুতেই উল্লেখ রয়েছে তক্ষকের দংশনে রাজা পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তাঁর পুত্র জনমেজয় সর্পনিধন যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেবার আস্তিকমুনির জন্য সর্পকুল রক্ষা পেয়েছিল। তবে আজও ভারতবর্ষে সর্পনিধন হয়েই চলেছে। গৃহস্থ বাড়িতে আমরা দেখেছি, বাড়িতে সাপ ঢুকলেই সেটি বিষধর না নির্বিষ তার বিচার না করেই মেরে ফেলা হয়। যদিও সর্পদংশনের মূল সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর, তবে আমাদের দেশ ও রাজ্যে সারা বছরই, বিশেষ করে জমিতে ফসল বোনার সময়ে সাপের উপদ্রব বাড়ে এবং সর্পদংশনের ঘটনাও ঘটে।
শীতের শুরুতে, রবি শস্যের পূর্বে, ধান কেটে ঘরে তোলায় সময়ে। মাঠেঘাটে হামেশাই সাপের দেখা মেলে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সর্পদংশনে মৃতের ৯৭ শতাংশই গ্রামে বাস করেন। ২০০৫ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র এক জন লোক সাপের কামড়ে মারা যান। অথচ ভারতে ফি-বছর গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। অস্ট্রেলিয়া ‘ইনল্যান্ড তাইপেন’, ‘কোস্টাল তাইপেন’, ‘ডেথ এডার’, ‘মুলগা’ প্রভৃতির কুখ্যাত বিষধর সাপের আবাসস্থল।
সারা পৃথিবীতে বিষধর সাপের প্রজাতি রয়েছে প্রায় দু’শো। ভারতে বিষধর সাপের প্রজাতির সংখ্যা মাত্র ৫২। সর্প বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতে সর্পদংশনে মৃত্যুর দায়ী মোটামুটি সাত থেকে আট ধরনের সাপ।
আমাদের রাজ্যে গোখরো, কেউটে, কালাচ ও চন্দ্রবোড়ার কামড়েই বেশিরভাগ মৃত্যু হয়।
এই প্রজাতির সাপগুলি ‘ড্রাই ব্রাইট’ না করে কামড়ের সঙ্গেই বিষ ঢালে। সাপের বিষ হলুদ ও কালো রঙের এক প্রকার তরল। এটি তাদের চোখ এবং মুখের কোণের মাঝের অংশের উপরে চোয়ালের উভয় পাশে অবস্থিত বিষথলিতে উৎপন্ন হয় ও সঞ্চিত থাকে। এটি আসলে সাপের পরিবর্তিত লালা যা নানা প্রকার প্রোটিন এবং উৎসেচকের সংমিশ্রণ। যখন এরা কোনও কিছুকে কামড়ে ধরে তখন বিষথলি থেকে বিষনালির মধ্যে দিয়ে তা বিষদাঁতে এসে পৌঁছায়। এদের বিষদাঁতগুলি অনেকটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জের মতো কাজ করে। এই বিষ তাড়াতাড়ি আক্রান্তের রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। সর্পবিশারদদের দাবি, একটি বিষধর সাপ এক বার কামড়ে প্রায় ২৭ থেকে ৭৫ শতাংশ বিষ নির্গত হতে পারে। এর পরে সাপের বিষের ঘাটতি পূরণ করতে তিন থেকে চার সপ্তাহ লেগে যায়।
সাপের বিষ সাধারণত চার রকমের হয়। যথা, নিউরোটক্সিক, হেমাটক্সিক, সাইটোটক্সিক ও মায়োটক্সিক। নিউরোটক্সিক মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এর অপর নাম ‘স্নায়ুবিষ’। এটি মাংসপেশিকেও অসাড় করে দেয়। ‘হেমাটক্সিক’ প্রভাবিত করে রক্তের লোহিত কণিকাকে। এটি রক্তকণিকা ভেঙে দেয়। শরীরের কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং মায়োটক্সিক পেশিকে নিস্ক্রিয় করে দেয়।
গ্রাম বাংলার যে ধরনের সাপের ছোবলে বিপদ ঘটছে তার মধ্যে একটি হল চন্দ্রবোড়া। এর অপর নাম ‘রাসেল’স ভাইপার’। এটি ‘ভাইপারিডি’ পরিবারভুক্ত বিষধর সাপ। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা এশিয়াতেই চন্দ্রবোড়ার ছোবলে মানুষ মারা যান। পশ্চিমবঙ্গে ফি-বছর প্রায় ২,০০০ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন চন্দ্রবোড়ার কামড়ে। সর্পবিশারদদের দাবি, বিষের তীব্রতার নিরিখে এই সাপ বিশ্বের পঞ্চম ভয়ঙ্কর। চন্দ্রবোড়া এক সেকেন্ডের ১৬ ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে কাউকে কামড়ে বিষ ঢেলে দিতে পারে। গ্রাম্য এলাকায় রাতের দিকে শুয়ে থাকার সময়ে কালাচ সাপের আক্রমণের ভয় থাকে। সর্প বিশারদদের দাবি, ‘ডোমনাচিতি’ বা কালাচের ছোবলে পরেও অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারেন না যে তাঁদের সাপে কামড়েছে। অনেকে আবার ঘুমের মধ্যেই মারা যান। পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ফি-বছরে বেশিরভাগ মানুষেরই মৃত্যু হচ্ছে প্রধানত এই দুই সাপের ছোবলে। অন্য দু’টি বিষধর ফণাযুক্ত সাপ হল ‘কেউটে’ ও ‘গোখড়ো’। উগ্র স্বভাবের এই সাপ দু’টি ‘এলপিডি’ পরিবারভুক্ত। এই দু’টি সাপের পাশাপাশি, গ্রাম বাংলায় বহু নির্বিষ সাপ রয়েছে।
এর সঙ্গেই বাড়ছে বিপদের আশঙ্কা। কারণ, সাপ কমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাপের বিষ সংগ্রহের কাজ। তারই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনাম তৈরির উপরে। গবেষণা থেকে জানা যায়, সাপের বিষের তীব্রতা ও প্রকৃতি এলাকা বিশেষে পরিবর্তিত হয়। ফলে, অনেক সময় দেখা যায় অ্যান্টিভেনাম দেওয়ার পরেও সেটি ঠিকমতো কাজ করছে না। এর বৈজ্ঞানিক কারণ হল, অ্যান্টিভেনাম যে এলাকার সাপের বিষের উপরে তৈরি হয়েছিল তা অন্য এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানকার সাপের বিষের তীব্রতা ও চরিত্রের সঙ্গে না মেলায় ঠিকমতো কাজ করে না। রাজ্য বন দফতরের ব্যাপক ধরপাকড়ের ফলে ২০১৬ সাল থেকে সাপের বিষ সংগ্রহ করার কাজ পুরোপুরি বন্ধ। ফলে রাজ্যের চাহিদা পূরণ করতে তামিলনাড়ু থেকে অ্যান্টিভেনাম আমদানি করতে হচ্ছে। তার ফলে বাড়ছে ঝুঁকি। কারণ, তামিলনাড়ুতে তৈরি অ্যান্টিভেনাম সেখানকার সাপের বিষের উপরে ভিত্তি করে প্রস্তুত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সাপের বিষের প্রকৃতি ও তীব্রতা আলাদা। ফলে চন্দ্রবোড়া বা কেউটের মতো সাপের দংশনে ক্ষেত্রে প্রায় দশ থেকে তিরিশ ভায়াল অ্যান্টিভেনাম দেওয়ার পরেও রোগীকে বাঁচানো যায়নি এমন ঘটনাও ঘটেছে। সর্পদশনে আক্রান্তকে দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরেও বাঁচানো না গেলে কুসংস্কার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক দশকে জমিতে ইঁদুরের মতো প্রাণীর সংখ্যা কমেছে। এতে ক্রমেই খাদ্য সঙ্কটে ভুগতে শুরু করেছে গ্রাম বাংলার সাপেরা। বাড়ছে সর্পদশনে মৃত্যুর ঘটনাও। এর জেরে সাপের উপরে আক্রোশ বাড়ছে মানুষেরও।
অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা সাপের কামড় থেকে রক্ষা পেতে পারি। সাধারণত দেখা যায়, ইঁদুর ও ব্যাঙের মতো প্রাণীদের সন্ধানেই সাপ গৃহস্থ বাড়িতে প্রবেশ করে। এরা যাতে গৃহস্থালির চারপাশে না থাকে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে বাড়ি ও তার চারপাশে সাপের আসা বন্ধ করা যেতে পারে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত সাবধানতা নিলে বা জমিতে ফসল তোলার আগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেও সাপের কামড় এড়ানো যায়। সবার আগে আমাদের বুঝতে হবে, সাপ মারলেই সমস্যা মিটবে না, বরং তা আরও গভীর হবে।
আঝাপুর হাইস্কুলের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy