কলকাতার পঞ্চসায়রে এক অসুস্থ মহিলার গণধর্ষণের ঘটনায় এক নাবালকও গ্রেফতার হয়েছে। দাবি উঠেছে, জুভেনাইল কোর্টে, নাবালকদের বিচার আইনের (জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট) অধীনে বিচার না করে, ওই কিশোরকে সাধারণ আদালতে ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে বিচার করা হোক। কারণ তার অপরাধ গুরুতর।
আইনত আজ এতে বাধা নেই। ২০১২ সালে নির্ভয়া-কাণ্ডে এক নাবালক অভিযুক্ত হয়েছিল। দেশজুড়ে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে যে প্রবল জনমত তৈরি হয়েছিল, তার প্রভাবে জুভেনাইল জাস্টিস আইনকে বদলানো হয়। শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠন, শরীরবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশ প্রবল আপত্তি করেছিলেন। তা শোনার পরিবেশই তখন ছিল না। সংশোধিত আইন বলছে, ১৬-১৮ বছরের নাবালক যদি ধর্ষণ, খুন, অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো কোনও গুরুতর অপরাধ করে, তবে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড এবং জুভেনাইল কোর্ট চাইলে তাকে সাধারণ আদালতে বিচারের জন্য পাঠাতে পারে। ফাঁসি ছাড়া যে কোনও সাজা হতে পারে তার।
পঞ্চসায়রের অভিযুক্তের বয়স (পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী) সতেরো বছরের উপর। পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে জুভেনাইল বোর্ড নাবালকের আর্থ-সামাজিক ও মানসিক অবস্থা যাচাই করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। রিপোর্টে লেখা হবে কিশোরটির পারিবারিক অবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান, অতীত অপরাধ, ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি মনোভাব ইত্যাদি। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নেওয়া হবে। রিপোর্টে যদি দেখা যায়, তার মানসিক পরিপক্বতা (‘ম্যাচিয়োরিটি লেভেল’) সাবালকের মতো তবে তাকে সাধারণ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হবে।
প্রশ্নটা কিন্তু থেকে গেল। কেননা, আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত মানব-সন্তানই নাবালক। ভারত এই চুক্তি বা কনভেনশন-এ স্বাক্ষরকারী দেশ। তা সত্ত্বেও ১৬-১৮ বছর বয়সিদের জন্য শিশুদের প্রাপ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে ভারত। দেশের অনেকগুলি রাজ্যে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত নাবালকদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার চলছে ফৌজদারি ধারা ও ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে। আইন সংশোধন করে নাবালকদের একাংশের থেকে সুরক্ষা সরানোর জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে আজও ভারত সমালোচিত হয় বার বার। ভ্রুক্ষেপ নেই সরকারের।
অথচ ২০১৫ সালের সংশোধনীগুলি দাঁড়িয়ে আছে অবৈজ্ঞানিক ধারণার উপর। বিজ্ঞানীরা বলেন, মস্তিষ্কের যে অংশ আবেগ, চিন্তা, ভাবনা, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা-বোধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, ১৬-১৮ বছর বয়সে সে অংশ তৈরি সম্পূর্ণ হয় না। তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা চলতে থাকে। কাজেই ওই বয়সে জেনে-বুঝে, কাজের কী পরিণাম হতে পারে, কী সাজা হতে পারে, তার সবটা বুঝেও তা অগ্রাহ্য করে অপরাধে শামিল হচ্ছে একটি কিশোর, এমন ধরে নেওয়া চলে না। বরং ওই বয়সে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে অনেক কম। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু ঘটিয়ে ফেলা, বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু করে ফেলা সহজ। কাজেই ১৬-১৮ বছরের কিশোরের অপরাধ যতই ‘ঘৃণ্য’ মনে হোক, প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর সঙ্গে তাকে এক করে দেখা চলে না।
এক জন নাবালককে জুভেনাইল বোর্ড যখন সাধারণ আদালতে বিচারের জন্য পাঠায়, তখন এক অর্থে বিচারের আগেই তাকে অপরাধী বলে ধরে নেওয়া হয়। এটা ভারতীয় সংবিধানের ‘অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’ ধারণার পরিপন্থী। জুভেনাইল বিচারব্যবস্থার মূল কথাই হল নাবালককে শুধরে নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করা। স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা। সাধারণ আদালতের বিচারে সাজা হলে ‘হোম’-এর বদলে তাকে জেলে পাঠানো হবে। তখন এই লক্ষ্য পূর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ দাগী অপরাধীদের সংস্পর্শে অপরিণত নাবালকেরও দাগী অপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
অপরাধের বিচার অবশ্যই চাই। কিন্তু অপরাধীর সঙ্গেও অবিচার করা চলে না, বিশেষ করে সে যদি নাবালক হয়। শিশুর প্রতি কতটা সংবেদনশীল আমরা? কিছু দিন আগেই শিশু শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে চোদ্দো বছরের উপরে নাবালকদের শ্রমের বাজারে যুক্ত করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। বহু নাবালক, বিশেষত ছেলেরা, স্কুলছুট হয়ে যোগ দিচ্ছে খাদান, ভেড়ি, নির্মাণ, পরিবহণের মতো শিল্পে, কাজ করছে কলকারখানায়। এ সব কাজের পরিবেশ প্রায়ই অপরাধপ্রবণ, মদ-মাদকের ব্যবহার নৈমিত্তিক ঘটনা। বাড়িতেও শৈশব থেকে নিয়মিত গার্হস্থ্য হিংসার সাক্ষী হয় শিশুরা। এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে সমাজ শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে পারে না, কিন্তু জেলে পাঠিয়ে তাদের ‘শিক্ষা’ দিতে চায়। অপরাধ কমানোর এটাই উপায় বটে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy