বিজ্ঞান আলোচনায়। ছবি শম্ভু জানার সৌজন্যে
ডাক্তারি পড়তে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ইন্টারভিউ দিলেন। তার পর বোস ইনস্টিটিউটে গিয়ে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম সাক্ষাতেই সত্যেন্দ্রনাথের পরামর্শ, ‘ফিজিক্সই তোর লাইন, ডাক্তারি পড়ে কী করবি’?’
জমিদারির হাল তখন পড়তির দিকে। একান্নবর্তী পরিবার। সব দিক রক্ষা করতে চিকিৎসক হতে হবে। কিন্তু একদিন ভাবার পর মত বদল করেন। পদার্থবিদ্য়ায় এমএসসি-তে ভর্তি হন সায়েন্স কলেজে। বেহালায় ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। কিছুদিন এইট/বি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রোড এলাকায়। তার পর সল্টলেকে পাকাপাকি। এক সাক্ষাৎকারে সূর্যেন্দুবিকাশ বলেন, ‘গবেষণাও যে পেশা হতে পারে...তার ইঙ্গিত এমএসসি পড়ার সময় পেয়েছিলাম’।
মেঘনাদ সাহা কৃতী ছাত্রটিকে নিজের ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। সূর্যেন্দুবিকাশ সাইক্লোট্রন গ্রুপে কাজ পান। আর্থিক সমস্যায় ভুগছিলেন তখন। অনেকেই ভাবতেন, জমিদারির আয় আছে। তাঁর টাকার দরকার নেই। কিন্তু বাড়ি থেকে তেমন টাকা পেতেন না। বোস ইনস্টিটিউটে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্টের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করলেন। কাজ পেলেন। কিন্তু মেঘনাদ সাহা শুনে অসন্তুষ্ট হন। জানতে চান সূর্যেন্দুর অসুবিধের কথা। নিজের সম্ভাবনাময় ছাত্রকে অন্যত্র পাঠাতে চাননি। সেই সময়ে ছয়-সাত মাস কোনও ফেলোশিপ পাননি সূর্যেন্দু। জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা হয়। ফলে বোস ইনস্টিটিউটে আর যোগ দিতে পারেননি। সেজন্য অপরাধবোধ ছিল। সূর্যেন্দুবিকাশ যোগ না দেওয়ায় সত্যেন বসুর প্রতিক্রিয়া ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্রকে তাঁর ইনস্টিটিউটে নেবেন না। পরে সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হয়ে ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচারে’র চিফ এডিটর হিসেবে তিনি সত্যেন বসুর সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন।
১৯৫৫ সালে ম্যাসস্পেকট্রোমিটার তৈরি করেন। শুরু করেন হালকা আইসোটোপ পৃথক করার কাজ। তখন ভারতে কেউই এই বিষয়ে গবেষণা শুরুই করেননি। আইসোটোপ সংক্রান্ত থিসিস জমা দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কানাডার অধ্যাপক ও ম্যাসস্পেকট্রোস্কোপিস্ট এইচ ই ডাকওয়ার্থ ১৯৬০ সালে ভারতে এসে তাঁর কাজের প্রশংসা করেন। কানাডায় কাজ করার আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। আইসোটোপ সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে তাঁর বই, ‘ভরের বর্ণালী’। পরে লেখেন ‘কণাত্বরণ’। ১৯৬২ সালে রেনে বার্নাস ফ্রান্সে ‘আইসোটোপ সেপারেটর’ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান। বহু বিজ্ঞানী এবং নতুন ভাবনার সঙ্গে পরিচয় হল। ইউরোপের কয়েকটি উন্নত গবেষণাগার দেখার সুযোগ পান। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমিক অ্যান্ড মলিকিউলার ফিজিক্সের ডিরেক্টর কিস্তেমেকার, নেলসন, এহ্বাল্ডদের সঙ্গে দেখা হয়। গবেষণার কাজে গতি আনতে ফ্রান্স থেকে আইসোটোপ সেপারেটর কেনেন। বিজ্ঞানীর ছোট ছেলে শান্তনু বলেন, ‘‘তখন গবেষণায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। খাওয়াদাওয়ায় মন ছিল না। কোনও সমস্যার সলিউশন মনে পড়ে গেল। ভোর পাঁচটায় রাজাবাজারের ট্রাম ধরে গবেষণাগারে পৌঁছে যেতেন। মাকে সংসার সামলাতে হয়েছে।’’
সূর্যেন্দুবিকাশের আবিষ্কৃত নতুন প্রযুক্তি মাইক্রোচিপ তৈরিতে সাহায্য করে। খুলে যায় পদার্থ বিজ্ঞানে গবেষণার নতুন দিগন্ত। গবেষণার পরীক্ষা ও উপলব্ধির অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে শুরু করেন বই। লিখেছেন, ১। পদার্থ বিকিরণ বিশ্ব। (এর জন্য নরসিংহ দাস পুরস্কার পান), (২) সৃষ্টির পথ (রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত), (৩) মহাবিশ্বের কথা, (৪) প্রগতি পরিবেশ পরিণাম, (৫) মেঘনাদ সাহা: জীবন ও সাধনা (ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে), (৬) পরমাণু থেকে বোমা ও বিদ্যুৎ। কয়েকটি ইংরেজি বইও আছে। দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় বহু লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি ও মোয়াট স্বর্ণপদক প্রাপক।
১৯৮৬ সালে সাহা ইনস্টিটিউট থেকে অবসর নেন বিজ্ঞানী। যদিও দু’বছর আগেই অবসর নেওয়ার কথা ছিল। ফিউশন গবেষণার জন্য জাপান থেকে একটি টোকাম্যাক যন্ত্র কেনা হয়। যন্ত্র স্থাপনে অবসরে দু’বছর বিলম্ব। হয়েছিলেন প্লাজমা প্রকল্পের উপদেষ্টা। এত কাজেও গ্রামের জন্য ভেবেছেন সূর্যেন্দুবিকাশ। অভিন্ন হৃদয় ভাই নির্মলেন্দুর সঙ্গে ১৯৪৩ সালে বাবার স্মৃতিতে গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন কিশোরীরঞ্জন স্মৃতি পাঠাগার। যা এখন টাউন লাইব্রেরি হয়েছে। গ্রন্থাগারের অধিকাংশ বই কিশোরীরঞ্জন ও ছেলে সূর্যেন্দুবিকাশের সংগ্রহ। তাঁর প্রতি বইয়ে বেদ, উপনিষদের বাণী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে উদ্ধৃতি রয়েছে। তিনি বলতেন, ‘‘আমি তো নিজে কিছু করি না, ওঁদের কাছ থেকে ধার করি।’’
ছয় শয্যা বিশিষ্ট সাউটিয়া হাসপাতাল, সাউটিয়া হাইস্কুল গড়ে তোলায় তাঁর অবদান আছে। পরিবারের দাবি, একবার বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস সূর্যেন্দুবিকাশকে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কোনও কারণে তিনি ভোটে দাঁড়াননি। মাঝে মধ্যেই সাউটিয়ায় আসতেন। ছেলে শান্তনু বলেন, ‘‘এতবড় বিজ্ঞানী হয়েওনুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। গ্রামে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন।’’ সাউটিয়া আসতেন দুর্গাপুজো, রাস, গরমের ছুটি, ধান কাটার সময়। গ্রামের নব্বই বছর বয়সি তাঁর বন্ধু কেদারনাথ দাস বলেন, ‘‘তিনি তাঁর বাবার কাছে বেহালা শিখতেন, আমি খোল শিখতাম। বেশ মিশুকে ছিলেন।’’
সাউটিয়ায় বিজ্ঞানীর উদ্যোগেই ১৯৮২ সালে গ্রামীণ বিজ্ঞান মেলা চালু হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয়ের মডেল, যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী হত। ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সে মেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানীর ভাই নির্মলেন্দুর ছেলে কৌশিক বলেন, ‘‘মৃত্যুর আগেও তিনি সাউটিয়া আসতে চেয়েছিলেন। নানা কারণে আনা যায়নি। তিনি বলেছেন এখানকার বাড়িটি যেন নষ্ট না হয়।’’ বড় ছেলে ফাল্গুনী ২০১৮ সালে মারা গিয়েছেন। ২০১৬ সালে মারা যান স্ত্রী শান্তিলতা। সূর্যেন্দুবিকাশের জেঠুর ছেলে বৃদ্ধ প্রবীরকুমার বলেন, ‘‘ইচ্ছা আর অধ্যবসায়ে বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন।’’
তবে বিজ্ঞানীর গ্রামে বিজ্ঞানচর্চা কমেছে। অনেকের দাবি, সরকারি উদ্যোগে আবার সাউটিয়ায় বিজ্ঞান মেলা হোক। শিক্ষক অংশুমান ভঞ্জ বলেন, ‘‘এলাকার ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞান ভাবনা গড়ে তুলতে বিজ্ঞান মেলার প্রয়োজন। তা ছাড়া এলাকার এতবড় বিজ্ঞানীকে আমরা ভুলতে বসেছি।’’ একসময়ে তাঁর লেখা পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পাঠক্রমে ছিল। তবে বিজ্ঞানীকে মনে রাখার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা অবশ্য করা হয়েছে। দাঁতন হাইস্কুলে প্রাক্তন ছাত্রের স্মৃতিতে ইকো ক্লাব গড়া হয়েছে। বিজ্ঞানীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র পুরনো বাড়িতে যত্নে রাখা।
কিন্তু কৃতী-স্মরণের সেরা পথ তো তাঁদের কাজের অনুসরণ। সাউটিয়া সে পথেই হাঁটতে চায়। তবে একার চেষ্টায় সম্ভব নয়। (শেষ)
তথ্য সহায়তা: প্রবীরকুমার কর মহাপাত্র, কৌশিক কর মহাপাত্র, কেদারনাথ দাস, শান্তনু কর মহাপাত্র, দাঁতন হাইস্কুলের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উৎসবের স্মারক পত্রিকা, সুরেশ দাসের সাক্ষাৎকার ও বিজ্ঞানীর লেখা বই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy