বর্ধমান রাজবাড়ি। ছবি: উদিত সিংহ
‘জহর প্রথা’— কথাটার সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। প্রচলিত অর্থে ‘জহর ব্রত’ বলতে আমরা সম্মানরক্ষার্থে নারীর আত্মবলিদানকে বুঝে থাকি। তবে ‘জহর’ শব্দটির সন্ধান করে অনেকে বলেন, সংস্কৃত ‘জতুগৃহ’ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। আবার ফার্সি শব্দ ‘জউহর’ থেকেও ‘জহর’ শব্দ এসেছে বলে অনেকে মনে করেই। ‘জউহর’ এর অর্থ ‘মনিমাণিক্য মূল্য’, ‘পুণ্য’ অথবা ‘সতীত্ব’। এটি প্রধানত রাজদের আমলে ভারতে প্রচলিত একটি প্রথা। যেখানে রাজারা যুদ্ধে পরাজিত হলে তাঁদের পরিবারের নারীরা সন্তান-সহ নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের তথা রাজ্যের সম্মান রক্ষা করতেন। হালফিলে ‘পদ্মাবৎ’ সিনেমাতেও জহরব্রত দেখানো হয়েছে। কথিত রয়েছে, ‘রানি পদ্মিনী’ প্রায় ১৬০০ নারী– সহ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন। এই জহর প্রথাটিকে অনেকে সতীর সঙ্গেও তুলনা করেন। বহু প্রাচীন সাহিত্যে ‘জহর-সতী’ শব্দেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
বাংলাও এই জহর প্রথার সাক্ষী থেকেছে। যেমন বল্লাল সেনের সময় হানাদারদের হাত থেকে সম্মান রক্ষার উদ্দেশে রাজপরিবারের নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেন বলে কথিত রয়েছে। বিক্রমপুরের ‘বল্লাল’ দিঘির কাছে একটি জায়গায় এই ব্রত পালিত হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। এই স্থানটি ‘পোড়া রাজার বাড়ি’ নামে পরিচিত।
একই ভাবে আমাদের বর্ধমান রাজবাড়িতেও একটি জহরব্রত পালিত হয়েছিল। এই ইতিহাস সম্পর্কে সে ভাবে চর্চা হয় না বলেই চলে। সেটা ১৬৯৬ সাল। দিল্লির মসনদে সম্রাট আওরঙ্গজেব। সেই সময় বর্ধমানের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজা কৃষ্ণরাম রায়। এই সময় বিষ্ণুপুরের রাজা গোপাল সিংহ চিতুয়া, বরদার জমিদার শোভা সিংহ এবং চন্দ্রকোনার জমিদার রঘুনাথ সিংহ, রাজা কৃষ্ণরামের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে ওড়িশার আফগান সর্দার রহিম খাঁকে আহ্বান জানিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
কৃষ্ণরাম বীরদর্পে যুদ্ধ করেও পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর সব ধনসম্পত্তি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে এলেও কৃষ্ণরামের পুত্র জগৎরাম রায় পালাতে সক্ষম হন। এই সময় বিদ্রোহী শোভা সিংহ কৃষ্ণরাম রায়ের অন্দরমহলের নারীদের বন্দি করে রাখেন। বন্দিনী নারীরা শোভা সিংহের হাত থেকে বাঁচার কোনও উপায় না দেখে সতীত্ব রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় বিষপান করে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে এক শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এই ঘটনা ঘটে।
রাজ পরিবারের যে নারীরা বিষপান করে জহর পালন করেছিলন তাঁদের ‘জহুরী’ নামে ডাকা হত। এঁরা হলেন, কুন্দদেবী, ফোতাদেবী, লক্ষ্মীদেবী, আনন্দদেবী, চিমোদেবী, কুঞ্জদেবী, কিশোরীদেবী, মুলুকদেবী, জিতুদেবী, লাজোদেবী, দাসোদেবী, পাতোদেবী, কৃষ্ণাদেবী প্রমুখ। অনেকে বলেন এঁদের মধ্যে নাকি ছ’জন ছিলেন রাজা কৃষ্ণরামের স্ত্রী।
অন্য দিকে, কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতী এই জহরব্রত পালন করতে না পেরে শোভা সিংহের হাতে বন্দি হন। এবং পরে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। শোভা সিংহ সত্যবতীর সম্মান হরণের চেষ্টা করলে সত্যবতী তাঁর বস্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছুরির আঘাতে শোভা সিংহকে হত্যা করেন। এবং নিজেরও জীবন বিসর্জন দেন।
পরে রাজা জগৎরাম রায় ঢাকার নবাবের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলে ঢাকার নবাব যশোরের ফৌজদারকে সেনাবাহিনী নিয়ে বর্ধমানের উদ্দেশে যাত্রা করার আদেশ দিলেন। যশোরের ফৌজদার ইব্রাহিম খাঁ সৈন্য জোগাড়ে অক্ষম হয়ে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে পালাতে বাধ্য হলেন।
দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেবের কানে এই খবর পৌঁছলে তিনি নিজের পৌত্র আজিমুসশানকে তৎক্ষণাৎ বাংলার সুবেদার ও জবরদস্ত খাঁকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করলেন। জবরদস্ত খাঁ সৈন্য জোগাড় করে বিদ্রোহী রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁদের পরাজিত করলেন এবং হারানো সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করলেন।
চিতার আগুনে, ছুরির ফলায়, তীব্র বিষপানে আরও নানা উপায়ে নারীরা বারবার তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা থেকেই এই প্রথার উদ্ভব। জহর ব্রতে যুগে যুগে নারীর এই আত্মবলিদানের মূল কারণ হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সতীত্বের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয় এবং তাকে নারীর মনের গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়া। নারীকে সেখানে বিজয়ীদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হত। ফলে, বিজয়ীদের হাতে পরাজিত পক্ষের নারীদের নানা ভাবে হেনস্তা হতে হত। সেখানে এই কারণেই যুগে যুগে জহরের নামে নৃশংস উপায়ে আত্মহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় অসহায় নারীদের। তবে এর পাশাপাশি, আমাদের এখানে প্রচলিত ছিল সতী প্রথা। সেখানে নৃশংস ভাবে বিধবা মহিলাদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোর করে বিধবা মহিলাকে সহমরণে পাঠানো হত। রাজা রামমোহন রায়ের সক্রিয়তায় সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইন পাশ হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও চোরাগোপ্তা সতী প্রথা চালু ছিল। শুধু বাংলা নয়, ভারতের নানা জায়গায়। বিগত শতকের ৮০-এর দশকে রাজস্থানে রূপ কানোয়ারকে এ ভাবেই সতী হতে হয়েছিল।
তথ্যসূত্র: দ্য ব্যালাডস অব বেঙ্গল: প্রথম খণ্ড, দীনেশচন্দ্র সেন।
বর্ধমান রাজবংশানুচরিত: গোপীকান্ত কোঙার, দেবেশ ঠাকুর।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy