Advertisement
E-Paper

নাটকে অভিনয় করতে করতে ভাল হওয়ার ইচ্ছে

সমাজের চোখে যাঁরা স্বীকৃত অপরাধী, যাঁদের চতুর্দিকে মস্ত প্রাচীরের ঘেরাটোপ, তাঁরা নাটকের জন্য বাইরে বেরিয়ে এলেন। সংশোধনের স্বপ্ন নিয়ে লিখছেন দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তীসুশান্তবাবুর মুখ থেকেই শোনা গেল নাটকে মূলত চারটি বিষয় মুখ্য—শরীর, কণ্ঠ, মন ও মঞ্চ।

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০৪:২৬
Share
Save

তাঁরা সমাজ-সংসার থেকে নির্বাসিত। তাঁদের দিন গুজরান গরাদের গর্ভে। জীবনে কোনও এক মুহূর্তের ভুলে তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত। তাঁরা আসলে কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারের আবাসিক। যাঁরা কোনও নেতিবাচক কাজের ফলস্বরূপ দণ্ডপ্রাপ্ত, তাঁদের এমন ইতিবাচক ভূমিকায় আশাবাদ জেগে উঠল যেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করলেন তাঁরা। তাঁদের এমন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মাতিয়ে দেওয়ার মহান কাজটি যিনি করেছেন, তিনি হলেন শ্রীসুশান্ত কুমার হালদার। পেশায় শিক্ষক হয়েও যাঁর মন-প্রাণ জুড়ে শুধুই নাটক। ১৯৮৯ থেকে কৃষ্ণনগরের ‘সিঞ্চন’ নাট্যগোষ্ঠীর যে পথচলা, তারই প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি।

সুশান্তবাবুর মুখ থেকেই শোনা গেল নাটকে মূলত চারটি বিষয় মুখ্য—শরীর, কণ্ঠ, মন ও মঞ্চ। শরীরী ভাষার প্রয়োগ, কণ্ঠের ওঠানামায় অভিনয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা, সৃষ্টিশীল মনটির সাহায্যে ব্যক্তি অভিনেতার ‘আমি’কে ভুলিয়ে নির্দিষ্ট চরিত্রটিতে ডুব দেওয়া আর অবশ্যই দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা সংবলিত মঞ্চটিকে যথাযথ ব্যবহার করার ক্ষমতা— সবটা মিলিয়েই নাটকের চরিত্রগুলি দর্শক-শ্রোতার সামনে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে, দর্শক সেই চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। রামকৃষ্ণের ভাষায় যাতে ‘লোকশিক্ষে’ হয়। সংশোধনাগারের আবাসিকদের দিয়ে এই বিষয়গুলি যথাযথ ভাবে করানোটা নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ পরিচালকের কাছে। তা-ও আবার ‘রক্তকরবী’র মতো শক্ত নাটক!

সমাজের চোখে যাঁরা স্বীকৃত অপরাধী, যাঁদের চতুর্দিকে মস্ত প্রাচীরের ঘেরাটোপ, তাঁরা নাটকের জন্য বাইরে বেরিয়ে এলেন। নাটক অভিনীত হল কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্রভবনে। নাটকের প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই সাবলীল অভিনয়ে তাঁরা মাত করলেন। যদিও সেটি সম্ভব হল সুশান্তবাবুর দক্ষ পরিচালনার গুণে। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের আত্মীয়-পরিজন। কারও বৃদ্ধ বাবা-মা, কারও ভাই, আবার কারও স্ত্রী-কচি ছেলেটাকে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে মঞ্চে দেখবেন বলে। নাটক চলাকালীন তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে চোখের জল মুছতে দেখা গেল। এ এক নিদারুণ দৃশ্য! ‘বিনা দোষে ছেলেটা জেল খাটছে’—বললেন এক বৃদ্ধ। কারও আবার দোষ প্রমাণ হয়নি, তা-ও বিচারাধীন বন্দি হয়ে বেশ কয়েক বছর জেল হেফাজতে। আক্ষেপ শোনা গেল তাঁর এক বন্ধুর মুখ থেকে। ছেলেটি নাকি পড়াশোনাতেও বেশ ছিল। মানুষটিকে দূর থেকে দেখেই চলে যেতে হবে। কিন্তু এটাই বা কম কীসের? সংসারের মানুষটির এমন গুণপনার খবর আগে জানা ছিল না!

সমাজের মূলস্রোতের বাইরে থাকা মানুষগুলিকে উৎসাহ দিতে সুশান্তবাবুর এই প্রয়াসে সহায়তা করেছেন সংশোধন প্রশাসন বিভাগ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রামকৃষ্ণ মিশন সারদাপীঠ বেলুড়মঠ। কৃষ্ণনগর কারাবিভাগের অধিকর্তাদের সামনেই নাটক মঞ্চস্থ হল। এসেছিলেন সারগাছি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মহারাজ স্বামী দিব্যানন্দজি। সংশোধনাগারের আবাসিকদের চিত্তশুদ্ধির এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি।

নাটকের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধির বিষয়টি যে কতটা সত্যি, তা আরও স্পষ্ট করে বোঝা গেল নাটকের শেষে কুশীলবদের সঙ্গে কথা বলে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক জন বললেন— ‘‘নাটকে অভিনয় করতে করতে আমার খুব ভাল মানুষ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে।’’ আর এক জনের প্রসঙ্গে সুশান্তবাবু বললেন— ‘‘নাটকে ওঁর চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওঁকে রাজি করাতে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। সমানে পালিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন সেই বলছেন— নাটক আমায় বাঁচতে শিখিয়েছে, এখন আর নাটক ছাড়া ভাবতে পারি না। আর এক জনের বক্তব্য— নাটক করে যে এত শান্তি জানতাম না।’’ ইতিপূর্বে ‘মহাবৃত্তে’ নামে বিবেকানন্দের জীবনের উপর একটি নাটক করিয়েছিলেন পরিচালক। তবে ‘রক্তকরবী’ যেন এই বন্দিদেরই জীবনের আলেখ্য। এই নাটক যেন তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে।

সুশান্তবাবুর মতে, অপরাধ প্রবণতা বোধ হয় সেই জায়গা থেকেই মাথাচাড়া দেয় যখন মানুষ ভিতরে ভিতরে শূন্য হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে। এই নাটকের দর্শনের সঙ্গে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে বন্দিরা তাই তাঁদের মধ্যেকার শুভবোধকে জাগিয়ে তোলেন। আর এটাও ঠিক যে, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। অভিনেতা না হয়েও কণ্ঠস্বর বা শরীরী ভাষার নিখুঁত পারিপাট্যে তাঁরা মঞ্চে সজীব করে তুললেন রাজা-বিশু-কিশোর-গোকুল-গোসাঁই ইত্যাদি চরিত্র। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়, সংশোধনাগারের বন্দিনীদের মধ্যে মেলেনি নন্দিনী ও চন্দ্রা। সিঞ্চনের দুই অভিনেত্রীই চরিত্র দু’টি করেছেন। নন্দিনী চরিত্রে প্রীতিলতা নন্দী ও চন্দ্রা চরিত্রে শুভ্রা রায়। তাঁদের অভিনয় অনবদ্য। বিশেষ করে চন্দ্রা চরিত্রটির বহুমাত্রিকতাকে অসাধারণ মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেত্রী শুভ্রা।

রবীন্দ্রনাথের এই রূপক সাংকেতিক নাটকটি বহু নাট্যসংস্থার প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়েছে। বহুরূপী প্রযোজিত ‘রক্তকরবী’ তো ইতিহাস তৈরি করেছে। কাজেই সেই নাটকটি নিয়ে কাজ করাটাও যথেষ্ট চাপের। কিন্তু সিঞ্চনের প্রযোজনাটিতে বহুচর্চিত এই নাটকটি অন্য মাত্রা লাভ করেছে। নাট্যভাবনায় অভিনবত্ব এনেছেন সুশান্তবাবু। প্রথমেই নজর কাড়ে মঞ্চসজ্জা। কিছুটা অংশ জালের আড়ালে রেখে বাকিটায় কয়েকটি বর্গক্ষেত্র রচনা করা হয়েছে। ঠিক যেমন স্যাটেলাইট মাধ্যমের ছবিতে পৃৃথিবীর ঘরবাড়িগুলি খোপের মতো লাগে। জালের প্রতীক এখানে প্রতিটি মানুষই যে জালের মধ্যে আটকে আছেন সেটি বোঝাতে। গোটা ব্যবস্থাটাই জালে আবদ্ধ। রাজাও এর বাইরে নন। কিন্তু তিনিও অন্তিমে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছেন। নতুন ফসলের গানে যখন সবাই মেতে উঠেছেন তখন রাজাও শামিল। ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’— তাঁদের মুখে। রাজা কিন্তু শেষে। এটাই নব ভাবনা।

নাটকের শুরুতে ইন-গেম ডায়ালগ পদ্ধতি বা কণ্ঠস্বরের প্রয়োগ না করে আড়াই মিনিটের একটি দৃশ্য রচিত হয়েছে। যেখানে যক্ষপুরীর শ্রমিকদের উপর অত্যাচার দেখানো হয়েছে। দৃৃৃৃশ্যভাবনা ও তাতে আলোর ব্যবহার বেশ আকর্ষণীয়। প্রথা ভেঙে এগিয়ে যেতে চাইলেই তার উপরে নেমে আসে সর্দারের চাবুক। বিশু পাগল এর অগ্রণী, পেশীশক্তিতে নয়, সে লড়েছে মগজের লড়াই। গজ্জু বিশ্বখ্যাত পালোয়ান হয়েও হেরে যায়, কারণ তার মগজ নেই। সর্দারের চাবুক খেয়েও বিশু মননের জোরে এগিয়ে যেতে পারেন। তার মুখে বসানো হয়েছে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ গানটি।

নন্দিনী ও চন্দ্রা যেন এক নারীর দুই সত্তা। নন্দিনীতে প্রেমময়ী নারীর ইতিবাচকতা আর চন্দ্রা সেখানে নারীর ধ্বংসাত্মক রূপ। সে ভোগবাদী। তাই ফাগুলালকে ছেড়ে সে সর্দারের পক্ষে যোগ দিয়েছে। চরিত্রটির মুখে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গান বেশ লাগল। এই ভাবনাগুলি নাটকটিকে অভিনবত্ব দিয়েছে। নিষ্ঠুর স্বর্ণলোভী শাসক যিনি নন্দিনীকে না পেয়ে তার প্রেমাস্পদ রঞ্জনকে হত্যা করতেও পিছপা হন না, শেষে তাঁকেই প্রজাদের সঙ্গে মেলানোর ভাবনাটি নতুন বার্তাবাহী। যান্ত্রিকতা থেকে রাজার মুক্তির এ হেন পরিক্রমাটি বেশ উপভোগ্য। সামগ্রিক ভাবেই সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে এই প্রয়াস আগামীর জন্য অনেক আশার আলো জ্বালিয়ে দিল।

লেখক শ্রীপৎ সিং কলেজের বাংলার শিক্ষক

Theatre Jail Inmates

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}