বিদেশমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর সম্প্রতি মন্তব্য করিয়াছেন, জোটনিরপেক্ষ নীতির যুগ শেষ হইয়াছে, তবে তাহার মধ্যে যে কূটনৈতিক স্বাধীনতার আদর্শ নিহিত ছিল, নূতন যুগেও তাহা ভারতের পক্ষে প্রাসঙ্গিক। মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। জোটনিরপেক্ষতার যুগ শেষ হইয়াছে অনেক আগেই। বস্তুত, জোটের ধারণাটি ঠান্ডা লড়াইয়ের সহিত ওতপ্রোত ছিল, সুতরাং সোভিয়েট ইউনিয়ন ও তাহার উপগ্রহগুলিতে তথাকথিত সমাজতন্ত্রের অবসানের সঙ্গেই সেই ধারণারও অবসান ঘটে। কিন্তু বিড়াল চলিয়া গেলেও তাহার হাসি কিছুকাল ভাসিয়া ছিল, তাহার পরে ক্রমে শব্দটি হারাইয়া যায়, জয়শঙ্কর তাহার স্মৃতি ফিরাইয়া আনিলেন। এবং স্মরণ করাইয়া দিলেন যে, ওই নীতি ছিল দুই মহাশক্তির টানাপড়েনে শাসিত দুনিয়ায় একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখিবার কূটনীতি। নিরপেক্ষতার মাত্রা ও বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া তর্ক চিরকালই ছিল, বিশেষত সত্তরের দশকের গোড়ায় সোভিয়েট ইউনিয়নের সহিত বিশেষ সামরিক চুক্তির পরে। নির্জোট আন্দোলনের মঞ্চে ফিদেল কাস্ত্রোর উজ্জ্বল উপস্থিতিও ছিল নিরপেক্ষতার ঘোষিত আদর্শের প্রতি একটি প্রকাণ্ড পরিহাস। কিন্তু কূটনীতিতে ঘোষণার মূল্য অনস্বীকার্য। ঘোষিত অবস্থানে নেহরু-ইন্দিরা-রাজীবের ভারত যে কোনও একটি ‘ব্লক’-এর শরিক হয় নাই, তাহার মূল্য মোদী সরকারের বিদেশমন্ত্রী স্বীকার করিতেছেন, ইহা লক্ষণীয় বইকি।
আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান ভারতের পক্ষে বিদেশ নীতিতে স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা অতীতের তুলনায় সহজ। জোট নাই। ঠান্ডা-লড়াইয়ের পরবর্তী একমেরু দুনিয়াও এখন কার্যত অতীত— আমেরিকা আজও প্রবলতম রাষ্ট্র বটে, কিন্তু তাহার একাধিপত্য বহুলাংশে খর্বিত এবং, ট্রাম্প থাকুন বা না থাকুন, একাধিপত্য জারি রাখিবার তাগিদও আগের মতো নাই। বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য কী দাঁড়াইবে, চিনের গুরুত্ব কতখানি হইবে, তাহার সহিত রাশিয়ার সমীকরণই বা কোথায় পৌঁছাইবে, ইত্যাকার বহু প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। এই ভারসাম্যের অভাব কি ভারতের পক্ষে সুবিধাজনক নহে? বহুমেরু কূটনীতিতে খেলিবার সুযোগ বেশি নয় কি? বিদেশমন্ত্রী তেমন ইঙ্গিত করিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য: ভারত, জাপান বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ‘মাঝারি’ শক্তিগুলির সম্মুখে এখন আপন গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করিবার সম্ভাবনা তৈয়ারি হইয়াছে। সম্প্রতি এই সম্ভাবনায় একটি নূতন মাত্রা যোগ করিয়াছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সমৃদ্ধ ও শক্তিমান সাতটি রাষ্ট্রকে লইয়া গঠিত জি-৭ গোষ্ঠীর আগামী সম্মেলনে তিনি বিশেষ আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন চারটি দেশকে: ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং রাশিয়া। ব্রাজিলেরও ডাক পাইবার সম্ভাবনা আছে। ইহা কার্যত জি-৭’কে জি-১১ বা জি-১২’য় রূপান্তরিত করিবার উদ্যোগ। ট্রাম্প কূটনৈতিক সূক্ষ্মতার ধার না ধারিয়া সেই উদ্দেশ্যটি জানাইয়াও দিয়াছেন। ক্ষমতাবানদের সভায় ভারত ডাক পাইতেছে, কূটনৈতিক সুসংবাদ বইকি।
কিন্তু এই আমন্ত্রণ সরকারকে সঙ্কটেও ফেলিয়াছে। সঙ্কটের কারণ: ওয়াশিংটনের নব উদ্যোগটি সরাসরি চিনকে কোণঠাসা করিবার উদ্যোগ। এই উদ্যোগে ভারত কত দূর এবং কতখানি শামিল হইবে? প্রশ্নটি কঠিন এবং জটিল। কেবল জি-১১ নহে, সামগ্রিক ভাবেই আন্তর্জাতিক কূটনীতির নির্মীয়মাণ নূতন ব্যবস্থায় আপন ভূমিকা নির্ধারণে ভারতের অত্যন্ত সতর্ক ভাবে পা ফেলা দরকার। সেই ব্যবস্থা যে রূপই ধারণ করুক, তাহাতে চিনের গুরুত্ব বিস্তর। পুরানো বিশ্ব ব্যবস্থার ভাষায় বলিলে, বৃহৎ শক্তির অনেকগুলি মেরুর অন্যতম হিসাবে চিন আপনাকে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিতেছে। কথাটি ভুল নহে, কিন্তু অসম্পূর্ণ। ‘মেরু’র পুরানো ধারণাটিই নূতন পৃথিবীতে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক থাকিবে কি? এক দিকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং উৎপাদন ব্যবস্থার অনন্ত বিশ্বায়ন, অন্য দিকে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিবিধ মডেলের আধিপত্য— বিশ্ব ব্যবস্থাটি উত্তরোত্তর অস্থির এবং স্ববিরোধে আকীর্ণ। যাঁহারা আমেরিকাকে এই ‘দিশাহারা’ দুনিয়ার হাল ধরিতে বলিতেছেন, তাঁহারা অতীতের ঔষধ দিয়া ভবিষ্যতের ব্যাধি নিরাময়ের খোয়াব দেখিতেছেন। এই পৃথিবীতে কূটনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ প্রত্যেক দেশকে প্রতিটি উপলক্ষে আপন স্বার্থ অনুসারে রচনা করিতে হইবে। চিন অবশ্যই ভারতের প্রতিপক্ষ, কিন্তু তাহার মোকাবিলা করিবার তাড়নায় আমেরিকার স্বার্থকে আপন স্বার্থের সহিত অভিন্ন ভাবিলে ভুল হইবে। নূতন বিশ্ব অ-ব্যবস্থায় কূটনীতি এখন সতর্ক পদচারণার নিত্যকর্মপদ্ধতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy