ফাইল চিত্র।
কিংবদন্তি দিয়ে তাঁকে আড়াল করে রাখি, যাতে তাঁর যাপনপ্রণালী ও আচরণ, তাঁর কর্মকাণ্ড ও বিবেচনাসমূহ, তাঁর প্রকাণ্ড হৃদয় ও সত্যনিষ্ঠা আমাদের অস্বস্তিতে না ফেলে, আমাদের বিড়ম্বিত না করে। গল্প দিয়ে ঢেকে রাখি তাঁর ঔজ্জ্বল্য ও যুক্তির প্রতি আগ্রহ। তাঁকে নিয়ে বই লিখি, আলোচনাসভায় বিস্তর আড়ম্বরে প্রণতি প্রদর্শন করি, কিন্তু যথা সম্ভব দূরে থাকি তাঁর পথ থেকে। কোথাও যেন তাঁর সঙ্গে পথের মাঝখানে মোলাকাত না হয়ে যায়, তার জন্য সর্বদা মজুত রাখি সসম্ভ্রম দূরত্ব। গল্প রচনা করি, গল্প দিয়ে তাঁকে অননুকরণীয় করে তুলি ক্রমশ। যাতে ফাঁকতালে তাঁকে অনুসরণও না করতে হয়। এই আত্মসমালোচনার সূত্রে বিদ্যাসাগরের দু’টি কাজ নিয়ে দু’-একটি কথা বলা যাক। তাঁর অজস্র কাজের ভিড়ে মাঝে মাঝে খানিক কম দ্যুতিময় মনে হয় এমন দু’-একটি কাজ।
ছোট অপু হরিহরের বাক্সের মধ্যে থেকে এক দিন আবিষ্কার করেছিল পোকায় কাটা সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ। সে বইয়ের মানে বোঝার বয়স হয়নি তার, কেবল বইটির আকার এবং গন্ধ তাকে টেনে রেখেছিল সে দিন। বিভূতিভূষণের নিজের সংগ্রহেও ছিল সেই বই। বাবা মহানন্দের কাছ থেকে এ বই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন কি না, তা জানা নেই, কিন্তু বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই যে এই আশ্চর্য গ্রন্থ বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পেতে থাকে, তাতে সন্দেহ নেই। বইয়ের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগর জানিয়েছেন, এশিয়াটিক সোসাইটিকে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন সায়নমাধবের সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ প্রকাশের বন্দোবস্ত হোক। সোসাইটি সেই ‘অফার’ মেনে তাঁকেই দায়িত্ব দেয় সম্পাদনার। বহু যত্নে বিদ্যাসাগর সম্পাদনার কাজ শেষ করেন। বাংলাদেশে এ বইয়ের পুঁথি দুর্লভ ছিল বলে তিনি কাশী থেকে সংগ্রহ করেন, এবং বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে প্রস্তুত করেন একটি নির্ভরযোগ্য সংস্করণ।
কেন বিদ্যাসাগরের এই প্রযত্ন? সায়ানাচার্য নিজে এক জন প্রখ্যাত বৈদান্তিক ছিলেন। কিন্তু অতি যত্নে তিনি বেদান্ত ছাড়াও অন্যান্য মুখ্য এবং আপাতচোখে গৌণ দর্শনপ্রস্থানগুলির একটি বেশ নির্ভরযোগ্য পরিচয়লিপি লিখেছিলেন। নিজের বিশ্বাসের দর্শনটির পাশাপাশি এই যে অন্যান্য প্রস্থানের পরিচয় দেওয়ার উদারতা দেখিয়েছিলেন সায়নাচার্য, বিদ্যাসাগরের কাছে নিশ্চয় তা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পর একাধিক বার তিনি চেষ্টা করেছিলেন এ বইকে ন্যায়শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে স্থান করে দিতে। কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রস্তাব মেনে না নিলেও হাল ছাড়েননি তিনি, আবার চিঠি লিখেছেন পরের বার। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সিলেবাস অনুযায়ী খানিক নব্যন্যায়পন্থী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। সকলেই জানেন, ন্যায়ের কৃতী ছাত্র হলেও কেবলমাত্র ন্যায়দর্শন চর্চা করবে তাঁর ছাত্রেরা— এ তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না। ভারতীয় ও পশ্চিমি— দুই ধারার দর্শনের সঙ্গেই ছাত্রদের পরিচয় ঘটুক, একটির সঙ্গে আর একটি ধারাকে মিলিয়ে দেখতে শিখুক তারা— সম্যক দৃষ্টির অধিকারী হয়ে উঠুক— এই ছিল তাঁর লক্ষ্য। উনিশ শতকের প্রাতিষ্ঠানিক চৌহদ্দিতে, বিশেষ করে সংস্কৃত কলেজের প্রথার মধ্যে জৈন বৌদ্ধ কিংবা চার্বাক মতের মতো ‘নাস্তিক’ দর্শনের চর্চা যে প্রায় অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধই থাকবে— এ তো স্বাভাবিক। বিদ্যাসাগর নিজেও সেই প্রথা ভেঙে কালাপাহাড়ি করার কথা ভাবেননি।
তাঁর কাণ্ডজ্ঞানের নানা নমুনা তো জানি আমরা সবাই। ফলত, তিনি সম্ভবত ঘুরপথ ধরার কথা ভেবেছিলেন। বেদান্ত, সাংখ্য, যোগ কিংবা ন্যায়ের ফাঁক গলে একটুখানি বৌদ্ধ কিংবা চার্বাক মতের সঙ্গেও তাদের পরিচয় ঘটুক, অনেকখানি আস্তিক্যের পাশাপাশি একটুখানি নাস্তিক্যও শিখুক তারা— এ-ই সম্ভবত তাঁর অভিপ্রায় ছিল। এবং সেই ফাঁক যদি সায়নাচার্যের মতো ঘোষিত ও স্বকৃত বৈদান্তিকের হাত ধরে জুটে যায়, তা হলে আপত্তি উঠবে না তত— এমন ভাবনা কি কাজ করেছিল তাঁর মনে? কিন্তু তাঁর অভিপ্রায় সম্ভবত অপ্রকট থাকেনি, কেননা সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ অনায়াসে প্রবেশাধিকার পায়নি পাঠ্যসূচিতে। তবে পাঠ্যসূচিতে সহজ প্রবেশ না ঘটলেও, বাংলাদেশে ধীরে ধীরে যে সে বই পরিচিত হয়ে উঠেছিল, তা টের পাওয়া যায়। পালারচয়িতা ঠাকুরমশাই হরিহর কিংবা অপু কিংবা তাদের সৃষ্টিকর্তা বিভূতিভূষণের বৃহৎ পাঠ্যসূচিতে তা জায়গা পেয়েছিল। বিদ্যাসাগরের ‘অফার’ এবং পরিশ্রমী সম্পাদনা বাংলাদেশে একদা দুর্লভ বইটির প্রসার ও প্রচার বাড়িয়ে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই। কলেজ স্তরেই ছাত্ররা ভারতীয় দর্শনের একটি সম্যক ধারণা তৈরি করে নিক— এই প্রত্যাশার মধ্যে, এবং সেই সূত্রে নিজেই সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ সম্পাদনা ও প্রকাশের আয়োজন রচনার মধ্যে তাঁর দৃষ্টির যে অনন্যতা ধরা আছে, তাঁর অভিপ্রায়ের যে বিশিষ্টতা ফুটে আছে— তা নজর করা দরকার।
এর পর বলি, বিদ্যাসাগরের দু’টি অসমাপ্ত কাজের কথা: দু’টি অভিধান তৈরির প্রকল্প যা চমৎকৃত করে আমাদের। শব্দমঞ্জরী এবং শব্দ-সংগ্রহ। একটি তৎসম শব্দের অভিধান, আর অন্যটি দেশি ও বিদেশি শব্দের ভান্ডার। প্রথমটি খুবই প্রাথমিক, ‘অ’ সমাপ্ত করে ‘আ’ অবধিও পৌঁছতে পারেননি তিনি। তবে দ্বিতীয়টি খানিক বিস্তৃত— ‘অ’ থেকে ‘হ’ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, সংগৃহীত এই বিদেশি-সূত্রে প্রাপ্ত এবং দেশি বাংলা শব্দের উৎস ও অর্থ লিখে যেতে পারেননি তিনি। ফলে, অসমাপ্ত এই অভিধান তেমন কোনও ‘কাজে’ লাগে না আমাদের। ঠিক কবে এই দু’টি কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন জানা নেই, কিন্তু আজকের আকালে আবছা এই ছবিটুকু জমিয়ে রাখতে চাই— শব্দ কুড়োচ্ছেন বিদ্যাসাগর, রাস্তাঘাটে মাঠে-ময়দানে হাটে-বাজারে— যেখানে যা পাওয়া যায় কুড়িয়ে তুলে রাখছেন খাতায়— দেশি শব্দের এক ভান্ডার গড়ে উঠছে ক্রমশ। সমকালীন অভিধানগুলির অন্দরে কিছুতেই ঠাঁই না পাওয়া সেই সব শব্দের জন্য আসন বুনে রাখছেন আদরে যত্নে। শব্দ তো কেবল ধ্বনিপুঞ্জ নয়, কেবল বস্তু কিংবা ভাব নির্দেশক নয় তারা, তাদের শরীরে মোলায়েম শৈবালের মতো লেগে থাকে স্মৃতি ও আদর, বহু বহু মানুষের স্পর্শের দাগ, মনোভঙ্গি।
কথা উঠতেই পারে, সব ছেড়ে তাঁর এই অভিধান-পরিকল্পনা নিয়ে পড়লাম কেন? এত এত কাজ তাঁর, সমাজ ও সাহিত্যের এত দিকে তাঁর এত সব প্রকাণ্ড ছায়া রয়েছে ছড়িয়ে— সে সব বাদ দিয়ে কেন এই অসমাপ্ত প্রকল্প নিয়ে এত কথা আজ? আসলে বাদ কিছুই দিইনি— তাঁর এই অসম্পূর্ণ কাজের মধ্যেও তাঁর চরিত্র ফুটে আছে কী ভাবে, সেইটাই বোঝার চেষ্টা করছি এখন। বিদগ্ধ নাগরিক মহলে অখ্যাত, অব-মানিত, অ-প্রত্যাশিত, এবং কখনও কখনও পরিত্যক্ত মানুষ জনের প্রতি তাঁর যে বিরাট হৃদয় প্রসারিত থেকেছে বরাবর, এই অভিধান-প্রস্তুতিতে, বিশেষত শব্দসংগ্রহ-তেও সেই হৃদয়ের স্পর্শ লেগে আছে; পিছনের সারির যে সব মুখের দিকে তাঁর নজর থেকেছে সর্বদা, তাঁর অসমাপ্ত অভিধানেও যেন তাদেরই প্রচ্ছায়া। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের একটি অচর্চিত এলাকা এই সব কুড়িয়ে রাখা শব্দের মধ্যে উপস্থিত রয়েছে।
তাঁর সংগৃহীত অজস্র শব্দের গায়ে স্পষ্টতই লেগে রয়েছে অকুলীন ছাপ। দেশি বুলি এবং আরবি ফারসি ইংরেজি প্রচলিত শব্দ, যা নানা সময়ে লোকমুখে ব্যবহৃত হতে হতে বাংলার চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েছিল, তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে চাইছিলেন বিদ্যাসাগর। রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের বঙ্গভাষাভিধান (১৮১৭) থেকে বিদ্যাসাগরের কাল অবধি বাংলা অভিধান সঙ্কলন তৈরি হয়েছে অনেক। তবে সেখানে এমন দেশি গন্ধমাখা শব্দের জন্য বেশি জায়গা বরাদ্দ ছিল না। কোনও কোনও শব্দ আজও বাংলা অভিধানের আওতায় এসে পৌঁছতে পারেনি। বিদ্যাসাগরের সংগৃহীত শব্দের অনেকগুলিই আমরা আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিধান হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এও খুঁজে পাব না। আনখা, আদরিআ, আকামাম, আনামাসা, আনুপাড়ি, আহ্লুদিআ, উসুলি, উসুমুসু, কোলাচিআ, সাঁঝানি, সিজিল, এবালিসি, কাঁতড়া, কোঁছড়িআ— এই রকম অজস্র শব্দ আমাদের মান্য অভিধানে নেই। বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই এ সব কুড়িয়ে এনেছিলেন তাঁর পরিচিত মানুষ জনের কথা থেকে, জীবন থেকে; এ সব শব্দের সঙ্গে নিশ্চয়ই লেগে ছিল মানবী উত্তাপ। সে সব উষ্ণতা বাংলা ভাষার শরীরেও মিশে যাক— নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের সাহচর্য এবং সম্মান পেয়েছিল এই সব শব্দ ও তার ব্যবহারকারী মানুষেরা— এ কথা ভাবলে আজ আমাদের ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর অশ্লীল উৎসবের দিনগুলিতে একটু সান্ত্বনা মেলে।
ছাতার আড়ালে মাথা ও শরীর ঢেকে এক বালক হেঁটে চলেছে বড়বাজার থেকে পটলডাঙার দিকে— বাসাবাড়ি থেকে সংস্কৃত কলেজের দিকে। অফুরন্ত সেই হেঁটে চলা— জেদি এবং প্রত্যয়ী। আশপাশ থেকে ঠিকরে আসছে কথাবার্তা, শব্দাবলি, বাগ্ধারা, কিন্তু তোয়াক্কা করছেন না তিনি, কিংবা হয়তো করছেন আসলে, হয়তো তখনই সংগ্রহ করে নিচ্ছেন বাংলা ভাষার লোকব্যবহারপুষ্ট শব্দাবলি। কুড়িয়ে রাখছেন সঙ্গে। অনেক পরে অসমাপ্ত একটি গ্রন্থের মধ্যে যা স্থান পাবে এক সময়। তাঁর ছাত্র এবং ভবিষ্যৎ-নাগরিকদের মেধা ও মননে সঙ্কীর্ণতা ছায়া না ফেলে যাতে, সেই লক্ষ্যে নিরলস ভাবে সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ সম্পাদনার পর তাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস, এবং অন্য দিকে অমানী ও পঙ্ক্তিবহির্ভূত শব্দসমূহ কুড়িয়ে-বাড়িয়ে অভিধানের স্বীকৃতি দান— বিদ্যাসাগরের অসমাপ্ত কাজেও রয়েছে এমন আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা। তাঁকে অনুসরণ করা খানিক বিপজ্জনক, তাই না?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অনল পাল
বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy