বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরের সাহচর্য লাভ করেছিলেন যাঁরা তাঁরা সকলেই মানুষটি সম্বন্ধে নানা কথা লিখেছেন, সরস সেই সব স্মৃতি প্রায় গল্পের মতো। গল্পের অতিকথায় বিদ্যাসাগর অনেক সময় ঢাকা পড়ে যান আবার কখনও কখনও তাঁর যুক্তি-বুদ্ধি-মন সেই পড়ে-পাওয়া স্মৃতির সুবাদেই একালের পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জীবনের শেষ পর্বে বিদ্যাসাগর ডাক্তারের পরামর্শে হাওয়া বদলের জন্য চন্দননগরে বাড়ি ভাড়া করেছিলেন। সেখানেই যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্নেহ-সাহচর্য পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর হুঁকো খেতে খেতে যোগেন্দ্রকে নানা গল্প বলতেন। মজলিশি মানুষ বলে কথা। বিদ্যাসাগরের মুখে যোগেন্দ্র ভাষা-বিষয়ক চমৎকার এক কাহিনি শুনেছিলেন। বর্ধমান শহরে এক বৃদ্ধ পণ্ডিত এক বার বিদ্যাসাগরকে আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন। ‘বাবা তুমি সংস্কৃত ব্যাকরণের রেলগাড়ী তৈরী করেছ, তাই তোমাকে আশীর্ব্বাদ করতে এসেছি।’ বৃদ্ধ-পণ্ডিতের এই আশীর্বচনের মানে বোঝার জন্য একটু টীকা-টিপ্পনী দরকার। আগে যখন রেলগাড়ি ছিল না, তখন বর্ধমান-কলকাতা যাতায়াত করতে অনেক সময় লাগত। সাহেবদের কল্যাণে রেলগাড়ি আসায় যাতায়াত সহজ হয়েছিল। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শিক্ষার সহজ ‘উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ রচনা করায় সংস্কৃত বাঙালিদের আর কঠিন লাগত না। পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘আমরা চতুষ্পাঠীতে দশ বারো বছর ধরে পরিশ্রম করে যা আয়ত্ত কর্ত্তে পারতুম না, এখন দেখি তোমার ব্যাকরণ পড়ে এক বছরে তাই...।’ রেলগাড়িতে যাতায়াতে কম সময় লাগে, বিদ্যাসাগরী ব্যাকরণেও কম সময়ে ভাষার ভাণ্ডারে ঢুকে পড়া যায়।
এই সরস গল্পটি পড়ে একটি প্রশ্ন জাগে। বিদ্যাসাগর কেন সহজ সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন? বিদ্যাসাগর নিজে খুব একটা সংস্কৃত লিখতে চাইতেন না, সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। রেলগাড়িতে নানা রকম যাত্রীর আনাগোনা। চলমানতাই সেই যানের বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন, অর্বাচীন কোনও যাত্রীই সেখানে ব্রাত্য নন। ভাষার রেলগাড়িও বহুমাত্রিক— এক ভাষার বগি নয়, নানা ভাষার বগিই ভারতীয় রেলের আদর্শ। বিদ্যাসাগর কেন সহজ সংস্কৃত ব্যাকরণ লিখে ভাষার রেলগাড়িকে সচল করেছিলেন, কেনই বা সংস্কৃতের প্রয়োজনীয় বিষয়কে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন তার উত্তর মিলবে পুরনো ভারত ও সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যে। বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত জীবনে পুরনো ভারতীয় আস্তিকতার নানা সংস্কার ও চিহ্ন বহন করতেন বটে, কিন্তু সেই চিহ্নগুলি তাঁর যুক্তিবোধ আর কাণ্ডজ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে দেয়নি। পুরনো আছে বলে নতুনকে বাদ দেননি। প্রয়োজনে পুরনোকে ছেড়েছেন, সংস্কার করে নিয়েছেন। তাঁর ভাষা-সংস্কৃতির ভাবনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
যে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন বিদ্যাসাগর সেই সংস্কৃত কলেজেরই পণ্ডিত ছিলেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। জয়গোপাল ১৮৩৮ সালে ‘পারসীক অভিধান’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই অভিধানটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার থেকে আরবি-ফারসি শব্দগুলিকে বাদ দেওয়া। দোকান, কলমের মতো খুবই চেনা সচল ‘বাংলা’ শব্দগুলি যে ‘অসংস্কৃত’ উৎস থেকে এসেছে জয়গোপাল তা খেয়াল করিয়ে দেন। তাঁর দাওয়াই ছিল যবনদের হাতফেরতা হয়ে আসা এই শব্দগুলিকে বাংলার ভাণ্ডার থেকে বাদ দেওয়া হোক। যবনরা বহিরাগত। বদলে চালু করা হোক পরিশুদ্ধ সংস্কৃত উৎস-জাত শব্দ। দোকানের বদলে ‘বিপণী’ লিখলেই হিন্দু অতীতের পুনর্নির্মাণ করা যাবে। জয়গোপালের এই প্রবণতার মূলে ছিল অতীত হিন্দু ভারত সম্বন্ধে এক নির্বিচার মুগ্ধতা, বাংলা ভাষাকে এই অতীতের ছায়া হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। ভাষা-সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল সচলতাকে মানতে চাইত না তাঁর রক্ষণশীল মন। উনিশ শতকীয় হিন্দু-অতীত নির্মাণকামী এই মনোভাবটি যে সহজে মরে না, ভূতের মতোই থেকে থেকে মাথা তোলে, একুশ শতকের ভারতে তা খুবই টের পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর তাঁর কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তিবোধ দিয়ে এই অতীতচারী হিন্দু মনোভাবের বিরোধিতা করেছিলেন।
সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের ধারণা কী ছিল তা ‘সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ নিবন্ধে তিনি জানিয়েছিলেন। সেই সময়ের গবেষণাগ্রন্থের সূত্রে তাঁর বক্তব্য, ‘সংস্কৃত ভারতবর্ষের আদিম নিবাসী লোকদিগের ভাষা নহে; সংস্কৃতভাষী লোকেরা, পৃথিবীর অন্য কোন প্রদেশ হইতে আসিয়া, ভারতবর্ষে আবাস গ্রহণ করিয়াছেন।’ তার পর কী হল? ভাষার নানা বদল ঘটল, অপরাপর ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের নানা বিনিময় ঘটল। জয়গোপাল আরবি-ফারসিকে বহিরাগত ভাষা হিসেবে দেখেন। সংস্কৃতকে প্রাচীন হিন্দু-ভারতের ভাষা হিসেবে অটল ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। বিদ্যাসাগর এই হিঁদুয়ানিকে মোটেই স্বীকার করেন না, সংস্কৃতকে অজর-অমর-আদি-অকৃত্রিম ভারতীয় ভাষা বলেও মনে করেন না। সে ভাষাও বহিরাগত। সংস্কৃত ভাষার প্রকাশক্ষমতা সম্বন্ধে তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, সেই ভাষার সাহিত্য তাঁর মনোহরণ করেছিল। তাই বলে সংস্কৃতকে অপরিবর্তনশীল হিন্দু-ভারতের সম্পদ হিসেবে তিনি বাঙালিদের মাথায় মোটেই চাপিয়ে দিতে চাননি। শ্রদ্ধা এক আর সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি আর এক। বিদ্যাসাগর শ্রদ্ধাশীল, সাম্প্রদায়িক নন। ধুতি ও চাদর যেমন তিনি পরতেন, তেমনই নিয়মানুবর্তী, যুক্তিনিষ্ঠ পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকেও সম্মান করতেন। যোগেন্দ্রকুমার বিদ্যাসাগরের ঘরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘এ কি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বসিবার ঘর না কোন ইউরোপীয় ভদ্রলোকের ড্রয়িংরুম?’ সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দু ভারত সম্বন্ধেও বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নির্মোহ। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য তিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, আর বাংলা ভাষাতেও তারা যাতে পোক্ত হয় সেও ছিল তাঁর অভিপ্রায়। নিজে কথা বলার সময় মুখের ভাষায় কঠিন সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করতেন না, বেনামে লেখার ক্ষেত্রেও কখনও কখনও মুখের ভাষার চাল ব্যবহার করেছেন। বাংলা ভাষায় পাঠ্যগ্রন্থ ও অনুবাদ গ্রন্থ রচনার সময় বাংলা ভাষার নিজস্ব মর্জিটি ভোলেননি। ভারতীয় ভাষাগুলির নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্যকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, এক হিন্দিভাষী পণ্ডিত এক বার তাঁর কাছে এসে সংস্কৃত ভাষায় কথা-বার্তা বলছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর কথার জবাব সংস্কৃতে না দিয়ে হিন্দিতে দিচ্ছিলেন। তিনি জানতেন যে নব্য ভারতীয় ভাষাগুলি ক্রমে বিকাশ লাভ করছে সেই ভাষাগুলিকে মর্যাদা দিতে হবে। সংস্কৃত আদি ভাষা বলে মাননীয় ও অপরিবর্তনীয় ভাবে অনুসরণযোগ্য, এই একভাষাসূত্র অর্থহীন। প্রতিটি ভাষার নিজস্বতা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই তিনি হিন্দি ও সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য অনুবাদ করার সময় স্বাধীনতা নিতেন। এই স্বাধীনতা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের সময়েও গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অনূদিত ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ মূল হিন্দি রচনার থেকে ভাবে-ভাষায় পৃথক, তাঁর ‘সীতার বনবাস’ সংস্কৃত রামকথার জগৎকে পুরোপুরি অনুসরণ করেনি। শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’-এর গদ্যরূপ দেন তিনি— স্থাননাম ও ব্যক্তিনামের বঙ্গীকরণ করেছিলেন নির্দ্বিধায়।
ভারতবর্ষের নানা ভাষার স্থানিক সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যাসাগর ক্রমবিকশিত ভারতীয় বহুভাষিকতাকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁর বাঙালি আত্মপরিচয়ের সঙ্গে প্রতিবেশী ভাষা-সংস্কৃতির বিরোধ ছিল না। বিরোধ থাকলে জীবনের শেষ পর্বে সকৌতুকে উড়িষ্যাবাসীদের মতো পান সাজতে বসতেন না, বাঙালিদের কলহপ্রিয়তা থেকে দূরে কর্মাটাঁড়ে আশ্রয় নিতে পারতেন না। আত্মপরিচয়ের অহমিকা আর ভাষিক এককেন্দ্রিকতার সাম্প্রদায়িকতা যখন মাথা তুলছে তখন ধুতি-চাদর পড়া এই মানুষটির দিকে আবার নতুন করে তাকাতে ইচ্ছে করে।তাঁর জীবন-যাপন ভাষা-ভাবনা যুক্তি সঙ্গত ভাবেই উদার ও বহুত্ববাদী।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy