গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
দেশের প্রধান বিচারপতির কাহারও নিকট কোনও দায়বদ্ধতা থাকে কি না, এই একটি কূট প্রশ্ন সাম্প্রতিক অতীতে বার বারই বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিতে দেখা যাইতেছে। প্রশ্নটি এতই জটিল যে, ইহার কোনও উত্তর বা সমাধান সর্বজনসম্মত হওয়া সম্ভব নহে। এক দিক দিয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতার অগ্রাধিকারটি অতীব বড় মাপের। তাহাকে কোনও ভাবে খাটো বা ছোট করিবার ঝুঁকি লওয়া মুশকিল। আবার অন্য দিক দিয়া, বিচারবিভাগ যে হেতু গণতান্ত্রিক সমাজের একটি অংশ, তাহাকে সমাজ ও সমাজের জন্য প্রয়োগযোগ্য আইন হইতে পৃথক করিয়া দেখাও হয়তো অনুচিত। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতকে এ বার এই প্রশ্নের এক প্রকার মীমাংসা করিয়া দিতে হইল। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের রায় বলিল, ভারতের প্রধান বিচারপতিও তথ্যের অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত। তাঁহার সম্পর্কে তথ্যাদি জানিবার অধিকার দেশের নাগরিক সমাজের রহিয়াছে। সন্দেহ নাই, এই রায়ের মধ্যে গণতন্ত্রের বিজয়দুন্দুভি বাজিতেছে। ভারত গৌরব বোধ করিতে পারে যে এমনকি তাহার সর্বোচ্চ আদালতকেও ‘পাবলিক অথরিটি’ প্রতিষ্ঠান হিসাবে মানিয়া সর্বপ্রধান বিচারপতিকে সেই প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতার ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। যে সংস্কৃতি তাহার নেতাকে ঐতিহ্যগত ভাবেই আরাধ্য হিসাবে দেখিতে আরাম বোধ করে, সেখানে আইনি বাধ্যতার অধীন হইতেছেন বিচারবিভাগের প্রধান— ইহা কম কথা নহে। কিন্তু তাহার সঙ্গে— অন্য দিকেও একটি কথা থাকিয়া যায়। গৌরবের সঙ্গে কিছু গভীর সংশয় মিশিয়া থাকে। সংশয়টির উৎস এই রায়ে বর্ণিত একটি সীমারেখা। সীমারেখাটি বলিতেছে: প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে তথ্যের অধিকার তত অবধিই প্রয়োগ করা যাইবে, যত দূর তাঁহার ব্যক্তিগত নিভৃতির অধিকারের সহিত তাহার কোনও সংঘর্ষ হইবে না। বিচারপতির এই ‘নিভৃত পরিসর’-এর মধ্যে কী কী থাকিতে পারে, তাহার কিছু দৃষ্টান্ত এই রায়ের সহিত সংযোজিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, তালিকাটি সম্পূর্ণ নহে। অন্যান্য কিছু বিষয়ও প্রয়োজনে/ক্ষেত্রবিশেষে ‘ব্যক্তিগত’ হিসাবে গণ্য হইতে পারে।
ব্যক্তিগত নিভৃতির অধিকারের কথা সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে এই প্রথম শোনা গেল না। গত কয়েক বৎসরে আধার সম্পর্কিত রায়ে, ব্যক্তিগত পরিসরের রায়ে এই কথা একাধিক বার বিভিন্ন বিচারপতির বয়ানে উঠিয়া আসিয়াছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিপুল, বুঝিতে কষ্ট হয় না। এই রায়ের মধ্যেও সীমারেখাটি কেন রাখিতে হইতেছে, তাহাও বোঝা সহজ। তবে কিনা, ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করিতে গিয়া স্বচ্ছতার নীতির সহিত রফা করা হইতেছে কি না— প্রশ্ন এইখানেই। ব্যক্তি-অধিকারের যুক্তির মধ্যে তাই একটি উল্টা সঙ্কটও থাকিয়া যায়। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, ব্যক্তির আয় কিংবা আয়কর সংক্রান্ত তথ্য এক অর্থে অসুখবিসুখ বা ঔষধের মতো অত্যন্ত ‘ব্যক্তিগত’ পরিসরের অন্তর্গত। আবার এক ভিন্ন অর্থে কিন্তু তাহা সামাজিক ও নাগরিক দায়বদ্ধতার প্রমাণও বটে। এমতাবস্থায়, যে ব্যক্তি ‘পাবলিক অথরিটি’ হিসাবে অগ্রগণ্য এবং অভিভাবকপ্রতিম, তাঁহার ক্ষেত্রে এই সব বিষয়েও কোনও অস্বচ্ছতা থাকিয়া যাওয়া কি বাঞ্ছনীয় হইতে পারে? সে ক্ষেত্রে তাহা কি প্রতিষ্ঠানেরই স্বচ্ছতার ক্ষতিসাধন করে না? বিচারপতিদের ক্ষেত্রে এই সব ‘ব্যক্তিগত’ তথ্যও প্রধান বিচারপতির নিকট পেশ করিতে হয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে? তিনি কাহার নিকট দায়বদ্ধতা রাখিবেন? প্রশ্নচিহ্নগুলি রহিয়া গেল। বেশ বড় মাপের প্রশ্নচিহ্ন। সন্তোষজনক উত্তরে পৌঁছাইবার কাজটি সহজ নহে, বলাই বাহুল্য। হয়তো দ্রুত সাধনযোগ্যও নহে। কিন্তু প্রশ্নচিহ্ন যে থাকিয়া গেল, সেটুকু অন্তত মনে রাখা জরুরি। গণতান্ত্রিক নীতি ও রাজনীতিকে পরবর্তী ধাপে উত্থিত করিবার জন্যই জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy