Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
pakistan

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুরবস্থার জন্য কি চিন দায়ী?

পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা, দুই দেশেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সঙ্কট এক প্রাথমিক সমস্যা।

গোলযোগের সমস্ত দায় চিনের উপর চাপিয়ে দেওয়া কিন্তু ভুল হবে।

গোলযোগের সমস্ত দায় চিনের উপর চাপিয়ে দেওয়া কিন্তু ভুল হবে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২২ ১০:৪৩
Share: Save:

ভারতের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা চিনের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ঋণ-সংক্রান্ত পরিকাঠামোগত প্রকল্পের কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে, যা এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সঙ্কটের আকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে। ১৪ মাস আগে আর একটি প্রতিবেশি দেশ মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে চিন সেখান থেকে সরে আসে এবং এক অর্থনৈতিক করিডরের প্রকল্প দাবি করে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। মলদ্বীপেও চিনা তহবিলপুষ্ট প্রকল্প আর ঋণ গ্রহণ মাথাচাড়া দিয়েছিল। সেখানে সরকার পরিবর্তনের পরে তা উধাও হয়। চিনের কাছে মলদ্বীপের ঋণের পরিমাণের বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়। ঋণের অস্বচ্ছতার ব্যাপারটি পরিচিত ছকেরই। কারণ, বাণিজ্যের জন্য ধার দেওয়া হচ্ছে— এমন ভান করে চিন তার প্রদত্ত ঋণের অনেকখানি অংশ চেপে যায় অথবা অন্য কোনও উদ্দেশ্যের দোহাই দিয়ে তাকে লুকিয়ে রাখে। মনে রাখা প্রয়োজন, চিনা ঋণ মোটেই খুব সস্তা কিছু নয়। কোনও দ্বিপাক্ষিক সহায়তার সময়ে অন্যান্য রাষ্ট্র যে পরিমাণ সুদ গ্রহণ করে, চিনকে প্রদেয় সুদের হার কম করে তার তিন গুণ বেশি।

এই বিষয়টিকে আমেরিকানরা একটি বিশেষ অভিধা দ্বারা ব্যক্ত করেন— ‘ঋণের ফাঁদ সংক্রান্ত কূটনীতি’। ভারতের আশপাশের তল্লাটে এক মাত্র বাংলাদেশই এই কূটনীতির বিষয়টি বুঝতে পারে এবং চিনা ঋণের ব্যাপারে সাবধানী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের তুলনায় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও চৈনিক ঋণ সংক্রান্ত প্রকল্পের প্রতি বাংলাদেশের নির্ভরতা প্রথমোক্তের এক-চতুর্থাংশেরও কম। নেপালও এ বিষয়ে সাবধানী পদক্ষেপ করেছে। এই অঞ্চলের সেই দেশগুলিই বিপাকে পড়েছে, যারা চৈনিক ঋণের ব্যাপারে তাদের দরজা হাট করে খুলে রেখেছিল।

সব দিক বিচার করলে শ্রীলঙ্কার কাহিনিটিই সব থেকে মর্মান্তিক।

সব দিক বিচার করলে শ্রীলঙ্কার কাহিনিটিই সব থেকে মর্মান্তিক। ছবি: রয়টার্স।

এ সত্ত্বেও গোলযোগের সমস্ত দায় চিনের উপর চাপিয়ে দেওয়া কিন্তু ভুল হবে। পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা— দুই দেশেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সঙ্কট এক প্রাথমিক সমস্যা। যা তাদের কোভিড অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কালে আরও বেশি সঙ্কটাপন্ন করে তোলে। পাকিস্তান তিন দশকেরও কিছু বেশি সময়ে ১৩ বার আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয় (যার বেশির ভাগই ঋণের শর্ত পূরণে অক্ষমতার কারণে মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়) এবং সেই দেশ এক বেপথু অর্থনীতির রাষ্ট্রে পর্যবসিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের আইএমএফ ঋণ স্থগিত রাখা হয়েছে এবং চিন পাকিস্তানের অনুরোধে এই বিপদে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর বিনিময়ে চিন কিন্তু তাদের প্রকল্প সংক্রান্ত ঋণদানের কঠোর শর্তগুলি থেকে এক চুলও সরে আসেনি। কিন্তু যখন সৌদি আরবের মতো দেশ তাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন কোনও গ্রাহক রাষ্ট্রের শেষ আশ্রয় হিসেবে প্রকৃত ঋণদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। তার ‘ঋণ-আসক্তি’ নিয়ে পাকিস্তানকে একটুও বিড়ম্বিত বলে মনে হয়নি। বরং সম্প্রতি ইমরান খান শেষ চেষ্টা হিসেবে ৪.২ বিলিয়ন ডলারের ‘বাণিজ্যঋণ’ চেয়ে বসে আছেন। যদি এই প্রস্তাবে চিন রাজি হয়, ইমরান কাঙ্ক্ষিত ঋণের মাত্রাকে দ্বিগুণেরও বেশি করে ফেলবেন। কার্যত চিনই পাকিস্তানের সব থেকে বড় ঋণদাতা।

সব দিক বিচার করলে শ্রীলঙ্কার কাহিনিটিই সব থেকে মর্মান্তিক। সেখানে কর এবং মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর অনুপাতে গত তিন বছরে এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অবনমন ঘটেছে। অবশ্যম্ভাবী ভাবে দেশের ঋণের হারে তার ছায়াপাত ঘটেছে, বাজেট-ঘাটতি বিস্ময়কর ভাবে বেড়ে জিডিপি-র ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক ঋণ (যা মূলত রাজকোষের ঘাটতি মেটাতেই ব্যয় হয়ে গিয়েছে) শোধের বিষয়টি দুরূহ থেকে ক্রমে অসম্ভবের দিকে ঢলে পড়েছে, যার ফল দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক বিনিময়ের সঙ্কট এবং দেশের মুদ্রার মানের অপ্রতিরোধ্য পতন। আশ্চর্যজনক ভাবে রাজাপক্ষে এবং তাঁর অনুগামী গোষ্ঠীর লোকেরা রাতারাতি ‘অর্গ্যানিক’ চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। অর্গ্যানিক কৃষির অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ বন্দনা শিবার মতো ব্যক্তিত্বের পরামর্শে সে দেশের সরকার অর্গ্যানিক কৃষি যে একটি গজদন্ত মিনারবাসীদের জন্য উপযুক্ত বিষয়, তা মানতে অস্বীকার করেছে। এবং এই ধরনের মহার্ঘ কৃষিপণ্যের ক্রেতা যে শুধু মাত্র উচ্চবিত্তরাই, সে কথা মানতে চায়নি। কৃষিক্ষেত্রে এক গুরুতর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে সরকার পিছু হঠেছে। কিন্তু তার হাতে ডলারের সেই যোগান আর নেই, যা দিয়ে সে সার আমদানি করতে পারবে। এখন জাহাজ বোঝাই খাদ্যশস্য শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছে ভারত থেকে এবং (আশ্চর্যের কিছু নেই) বাংলাদেশ থেকে।

তিন দশকেরও কিছু বেশি সময়ে ১৩ বার আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয় পাকিস্তান (যার বেশির ভাগই ঋণের শর্ত পূরণে অক্ষমতার কারণে মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়)।

তিন দশকেরও কিছু বেশি সময়ে ১৩ বার আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয় পাকিস্তান (যার বেশির ভাগই ঋণের শর্ত পূরণে অক্ষমতার কারণে মাঝপথে পরিত্যক্ত হয়)। ছবি: রয়টার্স।

এ ব্যাপারে চিনের ভূমিকা এবং দায়ের জায়গাটি ঠিক কী? এক কড়া ঋণদাতা হিসেবে চিন যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই পা রেখেছে এবং অতিরিক্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছে। প্রকল্প এবং ঋণ সেই সব দেশেই গিয়ে পৌঁছেছে, যারা প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী এবং রণকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই সব রাষ্ট্রের ৭০ শতাংশেরই তরফে ঋণ পরিশোধের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও সম্ভাবনা নেই এবং আরও স্পষ্ট ভাবে বললে, আদৌ কোনও সম্ভাবনা নেই। এদের সামনে বহিরাগত সাহায্যের প্রত্যাশী হওয়া ছাড়া তেমন কোনও পথও খোলা নেই। ঋণদান থেকে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের বিষয়টি। প্রকল্পের স্থাবর উৎসগুলিকে দ্বিপাক্ষিক হিসেবে দেখিয়ে চিন সেগুলির উপর তার আগ্রহ ব্যক্ত করতে থাকে। এই দখলদারির কৌশলের আর একটি উপাদান হল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে সহযোগিতা লাভ (শ্রীলঙ্কার মহাপক্ষে পরিবার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ)।

তা সত্ত্বেও এ কথা মানতে হবে, যে সব রাষ্ট্রে রাজনৈতিক গোলযোগ আর অর্থনৈতিক অব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে চিন সুবিধা নিয়ে থাকলেও অঘটনের হোতা কখনই ছিল না। বরং অনেক ক্ষেত্রে চৈনিক ঋণ সমস্যার সমাধানও করেছে। এমনকি, পাকিস্তানের শক্তি সংক্রান্ত ঘাটতির চিরাচরিত সমস্যাকে মেটাতে চিনের দেওয়া ঋণ অনেকখানি কাজেও এসেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি সম্পূরক হিসেবে যে সব সংস্কার করা উচিত ছিল, তা না হওয়ায় ফলদায়ী প্রকল্পও অর্থনৈতিক জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। সেই কারণেই বেসরকারি বা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে পরিকাঠামোগত প্রকল্প রূপায়ণের বিষয়টি তেমন সুবিধার বলে বিবেচিত হয়নি, মহার্ঘ বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে ফেলেছে। এই সব ঘটনার পিছনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির নিজস্ব দায় বড় কম নয়। কাজেই খামোখা বেজিংয়ের উপর দোষ চাপিয়ে কি কোনও লাভ আছে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE