Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
মসজিদের নীচে মন্দিরই ছিল, তার অকাট্য প্রমাণ আজও নেই

বিশ্বাসই কি গুরুত্ব পেল?

দেশের বেশির ভাগ মানুষই চাইছিলেন, এ বার শান্তি আসুক— যে কোনও মূল্যে। আদালতের বেঞ্চের প্রশংসা করতেই হবে— ১০৪৫ পাতার এই রায়ে পৌঁছনোর জন্য তাঁদের তথ্যপ্রমাণের পাহাড় পেরিয়ে আসতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে অজস্র শুনানি। রায়টিতে তাঁরা ভারসাম্য বজায় রাখতেও যথেষ্ট সফল।

জহর সরকার
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

গত শনিবার, ৯ নভেম্বর, অনেক কিছুই হল। বার্লিন প্রাচীর ভাঙার ৩০ বছর পূর্ণ হল; শিখরা ভিসা ছাড়াই গেলেন পাকিস্তানের পবিত্র করতারপুর সাহিব গুরুদ্বারে; মুসলমানরা প্রস্তুত হলেন হজরত মহম্মদের আসন্ন জন্মদিন পালন করতে; কলকাতা আর মুম্বই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করল ঝড়ের জন্য, দিনভর বৃষ্টি হল। কিন্তু, গোটা দেশের নজর ছিল দিল্লিতে, সুপ্রিম কোর্টের দিকে। আদালত অযোধ্যার জমি-বিবাদের মামলায় রায় দিল। এই বিবাদ ইতিমধ্যেই বহু হাজার মানুষের প্রাণ কেড়েছে। লক্ষণীয়, ১৯৯২ সালে মসজিদ ধ্বংস হওয়ার আগে এবং পরে যারা দাঙ্গা, লুটতরাজ, হত্যা করেছে, তারাও এ বার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। যেখানে যেখানে গোলমাল হওয়ার আশঙ্কা, সর্বত্র পুলিশ আর আধাসামরিক বাহিনীতে ছয়লাপ। পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের তরফে প্রধান বিচারপতি তাঁর রায় যখন ঘোষণা করছেন, তাঁর প্রতিটি বাক্য গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ।

দেশের বেশির ভাগ মানুষই চাইছিলেন, এ বার শান্তি আসুক— যে কোনও মূল্যে। আদালতের বেঞ্চের প্রশংসা করতেই হবে— ১০৪৫ পাতার এই রায়ে পৌঁছনোর জন্য তাঁদের তথ্যপ্রমাণের পাহাড় পেরিয়ে আসতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে অজস্র শুনানি। রায়টিতে তাঁরা ভারসাম্য বজায় রাখতেও যথেষ্ট সফল। বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমির অধিকার দেওয়া হল হিন্দুদের। তাতে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছেন। এই রায় যদি বিপরীতমুখী হত, তবে তার প্রতিক্রিয়া কতখানি ভয়ানক হতে পারত, ভেবে অনেকে শিউরে উঠছেন। এই রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সেই হিংস্রতা এড়ানো গেল। তবে, পরিস্থিতি যত মারাত্মক হোক, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজটা শাসনবিভাগের। প্রশাসনের। উপযুক্ত ন্যায়বিধানের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, সন্দেহ নেই— কিন্তু, বিচারবিভাগ যদি রায় দেওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির কথাও মাথায় রাখে, তাতে প্রশাসনের লাভ। শবরীমালা মামলায় যেমন আদালত কঠিন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল, এবং তার ফলে জনমানসে বিপুল অসন্তোষও সৃষ্টি হয়েছিল— ভবিষ্যতেও আদালত তেমন রায় দেবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে।

ন্যায়বিচার যে সত্যিই হয়েছে, সমাজ যাতে সেটা দেখতে পারে, বুঝতে পারে, তা নিশ্চিত করাও জরুরি। শীর্ষ আদালত যে সিদ্ধান্ত করেছে, অর্থাৎ বিতর্কিত জমিটির দখল সংক্রান্ত যে তথ্যপ্রমাণ হিন্দুরা পেশ করেছে, তা মুসলমানদের পেশ করা তথ্যপ্রমাণের তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য— তার ন্যায্যতা বিচার করবার অধিকার আইন-বিশেষজ্ঞদের। রায়টি দেখে মনে হচ্ছে, “তথ্যপ্রমাণ বলছে, সংশ্লিষ্ট জায়গাটিতে একটি মসজিদের অস্তিত্বের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জায়গাটিকে রামলালার জন্মস্থান ভেবে হিন্দুদের উপাসনা বাধাপ্রাপ্ত হয়নি”— আদালতের এই অবস্থানটি এই মামলার পরিণতি স্থির করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড তাদের আবেদনে দাবি করেছিল যে ১৫২৬ থেকে ১৯৯২ অবধি মসজিদই এই জমিটি দখল করে রেখেছিল। কিন্তু, এই জমিটি যে টানা মসজিদের দখলে ছিল, তাতে মুসলমানদের উপাসনায় কখনও ছেদ পড়েনি, তা প্রমাণ করার পক্ষে আদালত সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আবেদনটিকে যথেষ্ট বলে বিবেচনা করেনি। মুসলমান সমাজের একাংশ ক্ষুব্ধ, নিরবচ্ছিন্ন উপাসনার ভাসা ভাসা দাবিই শেষ অবধি আদালতে জিতল। আদালতের বেঞ্চ যদিও মনে করিয়ে দিয়েছে যে “ধর্ম বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, আদালত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত করেছে”, হাওয়ায় কিন্তু অন্য কথা ভাসছে। কে জানে, অসংখ্য মানুষের বিশ্বাসের কোনও প্রভাব এই মামলার রায়ের উপর পড়েছে কি না।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি ডি ভি শর্মা যে রায় দিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দিয়েছে। সেই রায়ের ফলে ধর্মস্থানের জমির মালিকানা সংক্রান্ত হরেক মামলার ঢল নেমেছিল আদালতে। ২০১০ সালের রায়ে সাধুরা খুশি হয়েছিলেন, হিন্দু দক্ষিণপন্থীরাও। মর্মান্তিক চটেছিলেন উদারপন্থীরা। সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ে ২০১০ সালের সেই রায় নাকচ করে জানিয়েছে, স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে, এবং ১৯৯১ সালের ‘দ্য প্লেসেস অব ওয়রশিপ অ্যাক্ট’-কে মানতে হবে। আশা করা যায়, এর ফলে কাশী এবং মথুরার মতো বিতর্কিত ধর্মস্থানে শান্তি বজায় থাকবে। কিন্তু, নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। পাশাপাশি আরও একটা সমস্যা আছে। প্রত্নতত্ত্বের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু হিন্দু মন্দিরই তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধ মন্দির বা তার ধ্বংসস্তূপের ওপর।

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাবরি মসজিদের নীচে যে কাঠামো পাওয়া গিয়েছে, নিশ্চিত করে বলা চলে না যে তা কোনও মন্দিরেরই। বলা যায় না যে মন্দির ধ্বংস করেই বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব থাকাকালীন আমি আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)-এর সঙ্গে কাজ করেছি। ফলে, অযোধ্যার মতো বিতর্কিত জায়গায় তাদের কাজের চরিত্রের সঙ্গে আমি পরিচিত। মসজিদের কাঠামোর নীচে নিশ্চিত ভাবেই কিছু স্তম্ভ এবং মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। অনেকে বলেছিলেন, সেগুলি শৈলীগত ভাবে হিন্দু। কিন্তু, আরও খোঁড়াখুঁড়ি না করা অবধি তারা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেনি যে ওটা কোনও হিন্দু মন্দিরেরই অংশ ছিল। বস্তুত, বারাণসীর ডক্টর এ কে নারায়ণ, যিনি ১৯৬৯-৭০’এ অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের একেবারে গোড়ার দিকে নেতৃস্থানীয় ছিলেন, বিশ্বাস করতেন যে এখানে বৌদ্ধ মন্দির থাকার সম্ভাবনা প্রবল। ১৯৭৫-৭৬ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর বি বি লাল। তিনি এএসআই-এর কাছে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা করেননি কখনও। কিন্তু, ১৯৯০ সালের অক্টোবরে আরএসএস-এর পত্রিকা মন্থন-এ অযোধ্যায় হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখলেন। ২০০৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এএসআই-কে আরও এক বার অনুসন্ধান করার নির্দেশ দিল। এএসআই সেই নির্দেশ পালন করেছিল। সে দফায় ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রেডার’-ও ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই অনুসন্ধানের রিপোর্ট এখনও আদালতের হাতে রয়েছে। তা জনসমক্ষে এলে দেখতে হবে, তাতে কোনও নতুন কথা আছে কি না। সংবাদপত্র এবং ইন্টারনেটে যে লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো অবশ্য ইঙ্গিত করছে যে আরবি এবং দেবনাগরী, উভয় হরফই পাওয়া গিয়েছে, এবং ওখানে যে রাম মন্দিরই ছিল, তেমন কোনও অকাট্য প্রমাণ এখনও মেলেনি।

ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সেখানে রাষ্ট্র কী ভাবে ধর্মের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখবে, সে বিষয়ে বহু রায় ভারতীয় বিচারব্যবস্থা দিয়েছে। কাজেই, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে মন্দির নির্মাণ করতে হবে, এই কথাটা উল্লেখ করার প্রয়োজন আদালতের ছিল কি না, আদালতের প্রতি সম্মান রেখেও সেই প্রশ্ন ওঠানো যেতেই পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, বৈদিক যুগ থেকে গুপ্ত যুগ অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১৬০০ বছর, হিন্দুরা মন্দিরে উপাসনা করত কি না, তার কোনও যথাযথ প্রমাণ নেই। একেবারে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে এসে প্রথম সাঁচীতে হিন্দু মন্দিরের সন্ধান মেলে। আজ যে প্রাচীন মন্দিরগুলোর কথা আমরা জানি, সেগুলো তৈরি হয়েছে আরও পরে, সপ্তম থেকে একাদশ শতাব্দীতে। তার চেয়েও বড় কথা, অযোধ্যায় একটা মন্দির করলেই কি যথেষ্ট হবে?

পর্বতপ্রমাণ তথ্য ও সাক্ষ্য খতিয়ে দেখেছে আদালতের বেঞ্চ— ভেবেছেও প্রচুর। ১৯৪৯ সালে রামলালার মূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৯২ সালে মসজিদ ভাঙার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। মহামান্য আদালত সরকারের জন্য বেশ কয়েকটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। যারা মসজিদটি ভেঙেছিল, তাদের অপরাধের বিচারের মামলাটি তিন দশক ধরে চলছে। আশা ছিল, সেই মামলা শেষ করার সময়সীমাও বেঁধে দেবে আদালত। তারা তো শুধু একটি ধর্মীয় কাঠামো ভাঙেনি, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আমাদের গর্ব এবং বিশ্বাসও ভেঙেছিল।

লেখক: ভূতপূর্ব সিইও, প্রসার ভারতী

অন্য বিষয়গুলি:

Ayodhya Verdict Ram Mandir
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy