তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত জাতীয় সঙ্গীত। ছবি সৌজন্য: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ
ভদ্রলোকের নাম জেমস কাজিনস। এক জন আইরিশ নাট্যকার, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক। ১৯১৪ সালে অ্যানি বেসান্তের ‘নিউ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনার কাজ নিয়ে ডাবলিন শহর থেকে ভারতবর্ষে চলে আসেন। এর আগে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠে গীতাঞ্জলির কবিতা শুনে তাঁর অনুরাগী হয়ে যান। পরে ১৯১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। পরবর্তী কালে কাজিনসের সঙ্গে কবির সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় ‘নিউ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সৌজন্যে। কবির অনুরাগী এই আইরিশ সাহিত্যসেবী ১৯৩৭ সালের ৩ নভেম্বর ‘ম্যাড্রাস মেল’ পত্রিকার সম্পাদক সমীপেষু বিভাগে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। চিঠির বিষয় ছিল, ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কেন ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটি নির্বাচিত হওয়া উচিত। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত কি হতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সেই বিতর্কে বহু চিন্তাবিদ মত প্রকাশ করেন। কাজিনসও তাঁর মত দেন।
সে দিন ‘ম্যাড্রাস মেল’-এর পাতায় কাজিনস লেখেন: ‘একটা সম্পূর্ণ জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চতম কল্যাণের প্রতীক এই গান সমস্ত দেশে সুপরিচিত। এর সুর ও ছন্দ এমনই, নিশ্চিত উৎসাহের সঙ্গে সমবেত কন্ঠে এই গান গাওয়া চলে।...ভারতবর্ষে মানবজীবনের যে বৈচিত্র্য, তা এই জনগণ গানে যেমন ফুটেছে, তেমনি তার অন্তঃশায়ী সত্য ঐক্যের সন্ধান দিয়েছে। বহিরঙ্গের অসম্ভব মিলনের কথা বলেনি, উচ্চারণ করেছে তার সত্যিকারের আত্মিক মিলনের বাণী, যা ফুটে উঠেছে বৈশ্বিক জীবনের সঙ্গে মিলনের প্রতি তাঁর সার্বিক আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে, যে জীবনে আমাদের সকলেরই অংশ আছে...এই গানে যে প্রার্থনা ধ্বনিত হয়েছে, তাতে যে কোনও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ নির্দ্বিধায় যোগ দিতে পারেন।...’
কাজিনসের এই পক্ষপাত অনেক চিন্তাবিদের মতোই ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করতে সাহায্যই করেছিল। তা বলে এই নয় যে এই গানটি নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেছে। আজও এই গানটিকে নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে নানা মহলে। গানটির বাণী এমন সুমধুর হওয়া সত্ত্বেও কেন এমন বিতর্ক? এই বিতর্কের সন্ধান খোঁজ করা যাক।
১৯৩৭ সাল। নভেম্বরের কুড়ি তারিখ। ছিয়াত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথ উনত্রিশ বছরের এক যুবকের কৈফিয়তের উত্তরে একটি চিঠি লিখলেন। সেই চিঠিটি পরবর্তী কালে একটি ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়। কেন চিঠিটি ঐতিহাসিক দলিল, তার কারণ খুঁজতে ফিরে যেতে হবে আরও আগে। ১৯১১ সাল, সেবার কবি-কন্যা মীরা দেবীর অসুস্থতার জন্য শান্তিনিকেতনে ৭ পৌষের অনুষ্ঠানে কবি অনুপস্থিত ছিলেন। কলকাতায় জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ শহরে। সেবারই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের ২৬ থেকে ২৮ তারিখে কংগ্রেসের ২৬ তম অধিবেশন বসেছিল এই কলকাতায়। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন, সেদিনটি ছিল বুধবার, দুপুর বারোটা, অধিবেশন শুরু হল সরলাদেবী চৌধুরী, অমলা দাশ, দিনেন্দ্রনাথ, অমল হোম প্রমুখের সমবেত কন্ঠে ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’ গানটি দিয়ে।
ঘটনাচক্রে, এই সময়েই সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যুর জন্য রাজার আসনটি শূন্য হয়। ১৯১১-র ২২ জুন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে গ্রেট ব্রিটেনের সিংহাসনে সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক হল। তিনি অভিষিক্ত হয়েই ডিসেম্বরে সস্ত্রীক ভারত সফরে এলেন। ভারতের রাজধানী সেবারই দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। দিল্লিতে সেই রাজকীয় আসরে পঞ্চম জর্জ ভারতের জনসাধারণের জন্য কিছু রাজকীয় সাহায্য ও সুবিধা দানের কথা ঘোষণা করেন। তাঁর ঘোষণাগুলির মধ্যে ১৯০৫ সালে আনা বঙ্গভঙ্গের আদেশটিকে সরকারি ভাবে রদ ঘোষণা করা হয়েছিল।
এ দিকে কংগ্রেস অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর উদ্বোধনী সঙ্গীতটি পরিবেশনের পর কংগ্রেস নেতারা পঞ্চম জর্জ ও তাঁর স্ত্রীকে সৌজন্যবশত স্বাগত জানান, এবং বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার কারণে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেন। এই সৌজন্য এবং কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের পর দিন ‘দ্য ইংলিশম্যান’ এবং ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় এই সংবাদকে একটু ঘুরিয়ে ছাপা হয়। শুরু হয় বিভ্রান্তি। কারণ, প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছিল, সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ওই গান রচনা করেছেন। ব্যস আগুনে যেন ঘি পড়ল! রবীন্দ্র-বিরোধী দল এই বিভ্রান্তিমূলক সংবাদকে হাতিয়ার করে কবির বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচারে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন। দীর্ঘদিন যাবত এই মহাবিতর্কটি বাজারে চালু ছিল।
এর প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরে এই বিতর্কের আশু সমাধানের উদ্দেশ্যে কবির থেকে সাতচল্লিশ বছরের ছোট যুবকটি কবির কাছে সরাসরি এই গানের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্যের কথা এবং পাশাপাশি ব্যাখ্যাও জানতে চান। কবি সেই প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই যুবককে চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘শ্রীযুক্ত পুলিনবিহারী সেন—
জনগণমনঅধিনায়ক গানটি কোনও উপলক্ষ্য-নিরপেক্ষ ভাবে আমি লিখেছি কিনা তুমি জিজ্ঞাসা করেছ। বুঝতে পারছি এই গানটি নিয়ে দেশের কোনও কোনও মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে তারই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তোমার মনে জেগে উঠল।’
আসলে শুধু তো যুবক পুলিনবিহারী নন, সেই সময়ে বাজারে এটিই প্রচার হয়েছিল যে, পঞ্চম জর্জের কলকাতা আগমনকে কেন্দ্র করেই কবি এই ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’ গানটি রচনা করেছিলেন। সেদিন সেই ইংরেজি পত্রিকা দু’টিতে লেখা হয়েছিল ‘কয়েক জন বাঙালি ছেলেমেয়ে সমবেত কন্ঠে হিন্দিতে পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিতে জয়গান গেয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ সেই কারণে যুবক পুলিনবিহারীর পাশাপাশি তাঁর বিরোধীদের উদ্দেশে সেই চিঠিতে আরও লিখলেন,
“সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।”
এখানে প্রাথমিকভাবে ‘কবির বন্ধু’ বলতে অনেকেই ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরীর কথা ভেবেছিলেন। এমনকি, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেটেও লেখা হয়েছিল ‘...in December (1911) Rabindranath composes, at the request of Asutosh Chaudhuri, for the twenty-sixth session of the Indian National Congress in Calcutta, his famous national song Jana-gana-mana-adhinayak’
বরং প্রশান্তকুমার পালের মতো রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞদের মতে, গানটি রচনার জন্য রাজসরকারের প্রতিষ্ঠাবান বন্ধুটি হলেন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির স্যর মহারাজা উপাধিপ্রাপ্ত প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ যে অনেক সময় অনুরোধের গান লেখেননি তা তো নয়, তবে সম্রাটের জয়গান লিখবেন, এমনটা আশা করা বাড়াবাড়িই হয়েছিল। কবি এ কথা শুনে খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন বলাবাহুল্য। লিখেওছেন সে কথা—“শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল।”
সেই তাপের প্রতিক্রিয়ায় কবি বলেছিলেন: ‘‘তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।” এর পরেই সেই রাজভক্ত বন্ধুর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘তাঁর ভক্তি প্রবল থাকলেও বুদ্ধির অভাব কিন্তু ছিল না।’’
ফলে রবীন্দ্র-বিরোধীরাই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যাই হোক পুলিনবিহারী সে দিন এই প্রসঙ্গে কবিকে জিজ্ঞাসা না করলে ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’ গানটি আজও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকত। কারণ, গানটি কবে কোথায় রচিত হয়েছিল, তা জানা যায়নি। এমনকি এর কোনও পাণ্ডুলপিও পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র এই একটি কারণের জন্যই গোটা ভারতবাসীর আজ পুলিনবিহারী সেনের কাছে ঋণী থাকা উচিত।
গ্রন্থঋণ: পুলিনবিহারী জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য ১৯০৮ – ২০০৮: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ;
ইন্ডিয়া’জ ন্যাশনাল অ্যানথেম: প্রবোধচন্দ্র সেন;
রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা: সমীর সেনগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ;
ভোরের পাখি ও অন্যান্য প্রবন্ধ: প্রবোধচন্দ্র সেন, আনন্দ;
রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড: প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ;
রবীন্দ্রজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ;
লেখক রবীন্দ্র-গবেষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy