রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি পর পঞ্চান্ন বছরের ও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। যে তরুণ কণ্ঠগুলি মাতৃভাষার অধিকার চেয়ে গর্জে উঠেছিল তাঁরা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কিন্তু আশার কথা এই যে, বাংলাদেশে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরিরা আছেন। যারা ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনের এই যুগেও বাংলা ভাষার গৌরবকে অনেকাংশে ধরে রাখতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ধনী, উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সাহেবিয়ানা যে একেবারেই প্রকট হয়নি তা নয়। কিন্তু মাতৃভাষা সেখানে মর্যাদাহীন হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে পশ্চিমবাংলার চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবী যতই হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়েছে ততই বাংলা ভাষা গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছে। এ পার বাংলার বাঙালি শুধু বাঙালি নয়, ভারতবাসী ও বটে। কাজে অকাজে তাকে নিত্য যেতে হয় ভারতের অন্য প্রান্তে। স্বভাবতই তাকে হতে হয় হিন্দি ও ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ। বাঙালির বিনোদনের জগতেও হিন্দির আধিক্য প্রচুর। বাংলা থেকে অনেক অর্থ ব্যয়ে নির্মিত হিন্দি সিনেমা সিরিয়ালগুলি স্বভাবতই অনেক বেশি চাকচিক্য সম্পন্ন হয়। ফলে তরুণ প্রজন্মকে তা আকৃষ্ট করে বেশি। হিন্দি সিরিয়াল, হিন্দি সিনেমা দেখার অভ্যাস এখন বাঙালির ঘরে ঘরে। আবার কাজের প্রয়োজনে বহু অবাঙালি মানুষ ভিড় করেছেন বাংলায়। তারা বাঙালিদের সাথে হিন্দিতে কথা বলেন। বাঙালি কিন্তু উত্তরে হিন্দি বলে। তাদের বাংলা শেখানোর বিশেষ প্রয়াস করে না। আবার পশ্চিমবাংলার বহু জায়গায় দোকানের সাইনবোর্ড হিন্দি বা ইংরেজিতে লেখা হয়। বর্তমানের শপিং মল বা ব্র্যান্ডের দোকানগুলির নাম তো ইংরেজিতে লেখা হয় সর্বত্র। হিন্দি আর ইংরেজি ভাষার এই আগ্রাসনে বাংলা ভাষা আজ কোণঠাসা।
আবার সরকারি চাকরির বাজার ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। উদার অর্থনীতির এই যুগে দেশি বিদেশি কোম্পানিগুলি ভিড় জমাচ্ছে ভারতে। জীবিকার প্রয়োজনে সচেতন বাঙালি অভিভাবক সমাজ তাঁদের সন্তানদের আর বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়াতে বিশেষ আগ্রহী নন। এমনকি বহু ছেলেমেয়েরই দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয় হিন্দি। ফলে বাংলায় বাসরত বহু বাঙালি ছেলেমেয়েই এখন বাংলা বললেও লিখতে-পড়তে পারে না। অথচ এমনটি হওয়ার তো কথা ছিল না। কোনও একটি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হতে গেলে অন্য ভাষাকে অবহেলার প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি রচনা করেছিলেন। আবার তিনি গীতাঞ্জলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। যা তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছিল। এ বাংলাতে এখনও বহু মানুষ আছেন যারা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সবই ভাল জানেন। তাহলে মাতৃভাষাকে অবমাননা করার এই প্রবণতা—এই আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে আমাদের। কারণ মাতৃভাষার সাথে জড়িত হয়ে আছে আমাদের মূল্যবোধের শিক্ষাও। মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে না পারলে তার সাহিত্য, সঙ্গীতের সম্ভারে নতুন মণিমাণিক্য যোগ করাও সম্ভব হবে না।
এপার বাংলার সর্বত্র বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার কাজ, অবাঙালিকে বাংলা বলানোর প্রয়াস—এই সব মাঝে মাঝে দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রয়াসগুলি বিশেষ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু বাঙালি ছেলেমেয়েদের, যারা বাংলায় বাস করে তাদের অন্তত দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করা একান্ত প্রয়োজন। একুশে ফেব্রুয়ারি বহু স্কুল, কলেজে পালিত হয়। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বহু অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এই এক দিনের প্রয়াস বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। নতুন প্রজন্মকে বারবার একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস বলতে হবে। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য, সাহিত্য সম্ভার সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। কারণ তারাই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। তাদের হাতেই রয়েছে আগামী দিনের বাংলা গড়ার কাজ। এই কাজে অভিভাবকদের ও সচেতন হতে হবে। নিজ উদ্যোগে, নিজ দায়িত্বে সন্তানদের বাংলা ভাষায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিশু জন্মের পর প্রথম যে ভাষা শোনে তা মাতৃভাষা, প্রথমে যে ভাষায় কথা বলে তা মাতৃভাষা। তাই এই ভাষার সাথে তার আত্মিক বন্ধন রয়েছে। এই ভাষায় তার লিখনী, তার আবেগ অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রকাশিত হয়। সে জন্য একটু চেষ্টা করলেই একটি শিশুকে বাংলা পড়া এবং লেখা শেখানো যায়।
মাতৃভাষা তো কেবল ভাষা নয়। তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে মাটির সোঁদা গন্ধ, বড়দের স্নেহস্পর্শ ও শিকড়ের টান। বর্তমান যুগে সকল দ্বার রুদ্ধ করে বাঁচা সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। শুধু দরকার একটু মেলবন্ধনের। ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, প্রয়োজন নেই। ইংরেজি থাকুক না কাজের ভাষা হিসেবে, অর্থ উপার্জনের ভাষা হিসেবে। বাংলা ভাষা থাকুক আমাদের মনের মণিকোঠায় —আমাদের খুব ভালবাসার, আবেগের ভাষা হয়ে।
শিক্ষিকা নওপুকুরিয়া জানকীনাথ-যদুনাথ উচ্চবিদ্যালয়, বেলডাঙা
ঋণস্বীকার: মহান একুশে ফেব্রুয়ারি।
সম্পাদনা: ডঃ জীবনকুমার সরকার, মহম্মদ রাকিবুল আহমেদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy