১৯৬১ সালের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যার সঙ্গে ২০১১ সালের সমীক্ষার তুলনা করলে একটা জরুরি জিনিস দেখব। ১৯৬১ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা ছিল ১,৩৮,৯৬৮। ২০১১ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়ে গেল ৩১,২০,৪১৩ জন। ও দিকে এই সময়কালের মধ্যেই বিহারে বাংলাভাষীদের সংখ্যা ১২,২০,৮০০ থেকে ৩৩.৫৯% কমে হয়ে দাঁড়াল ৮,১০,৭৭১ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের সঙ্গে একটিরও মিল নেই। ফলে, যতই না আমরা একই ভারতের বাসিন্দা হই, আপাতদৃষ্টিতে হিন্দিভাষীরা পলাশের মতো রাঙিয়ে উঠছে আর অন্য দিকে, বাঙালিদের মতো, অন্য মাতৃভাষীদের সর্বনাশ নেমে আসছে। আবার হিন্দিভাষী ৩১,২০,৪১৩ জনের মধ্যে মাতৃভাষা হিন্দি মাত্র শতকরা ২২ জনের আর শতকরা ৬৫ জনের মাতৃভাষা ‘লামানি বা লাম্বাডি’। কিন্তু ভাষাবিদদের মতে ‘লামানি বা লাম্বাডি’ সংবিধানে বর্ণিত হিন্দি ভাষারই অন্তর্গত— তাই সংখ্যাগুরু হলেও এই মাতৃভাষাটিরও সর্বনাশ নেমে আসছে। অর্থাৎ জাতীয় স্তরে স্বাধীন কোনও অস্তিত্ব নেই। ভারতে প্রায় বেশির ভাগ রাজ্যেই ‘সাংবিধানিক হিন্দি ভাষা’ এবং ‘মাতৃভাষা হিন্দি’-র এই আশমান জমিন ফারাক। ফলে জাতীয় ভাষাই হোক আর হিন্দি ভাষার অন্তর্গত মাতৃভাষা হোক— জাতীয় স্তরে প্রতিটি ভাষারই গুরুত্ব ক্রমশ কমে আসছে। অর্থাৎ মাতৃভাষার স্বাধীনতা ক্রমশই সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং সেটা করা হচ্ছে অনেকটাই সংবিধান মেনে।
আসলে, আমাদের সংবিধান সরকারের উপর সব ভাষাভাষী নাগরিকের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা ও উন্নয়ন ঘটাবার দায়িত্ব যেমন আরোপিত করেছে তেমনই নির্দিষ্ট করে ‘হিন্দি ভাষা’-র প্রচার ও প্রসারের দায়িত্বও আরোপিত করেছে। সেই ১৯৪৯ সালে আমাদের নেতারা ‘হিন্দি’-কে ‘সরকারি যোগাযোগ রক্ষাকারী’ ভাষা হিসেবে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছিলেন। এই সরকারি যোগাযোগ রক্ষাকারী ভাষাটিকেই যে তাবৎ ভারতবাসীর ভাষা করে তুলতেই হবে, এমন কথাটি সংবিধানে স্পষ্ট করে নেই। ‘মাতৃভাষা’ তো মানুষের জন্মগত অধিকার, তাঁর ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি সবেরই ধারক-বাহক। মাতৃভাষা তো আর ‘পতাকা’ বা ভূখণ্ডের মতো জড়বস্তু নয় যে ইচ্ছে করলে রং পাল্টে নেব বা কিছু অংশ জুড়ে নেব। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের মাতৃভাষা ও সাংবিধানিক ও ভাষাবিদদের ‘হিন্দি’ ভাষা এক কথা নয়। কেউ কেউ এখানে রাজনীতিরও গন্ধ পেয়ে থাকেন। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে।
ক) অসমে ১৯৩১-৫১’র মধ্যে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) ‘অহমিয়া’-কে তাঁদের মাতৃভাষা বলে উল্লেখ করেন। খ) পঞ্জাবে ১৯৫১ সালে হিন্দুরা হিন্দিকে আর শিখেরা পঞ্জাবিকে তাঁদের মাতৃভাষা বলে ঘোষণা করেন। গ) জনজাতিরা বিশ্বাস করতেন, স্বাধীন ভারতে একটিমাত্র জাতীয় ভাষা: ‘হিন্দি’। এই ভাষাই তাঁদের শিক্ষা, চাকরি ও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে পারবে। অতএব এঁদের একটা বিরাট অংশ ‘হিন্দি’-কেই তাঁদের মাতৃভাষা বলে ঘোষণা করলেন।
১৯৬১ সালের সমীক্ষা বলে দেয়, ভাষাবিদেরা মাত্র ৯৭টি (যার মধ্যে মাতৃভাষা হিন্দিও আছে) মাতৃভাষাকে যোগ করে ‘সাংবিধানিক হিন্দি ভাষা’ তৈরি করেছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে ভাষাবিদেরা ১০,০০০ জনের কম বক্তা থাকলে সেই মাতৃভাষাটিকে ‘অন্যান্য ভাষা’-র অন্তর্গত করে বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে জুড়ে দিতে থাকলেন। এই মাতৃভাষাগুলির কোনও নাম থাকে না— ওরা কেবলই ‘অন্যান্য’। ১৯৬১ সালে এই প্রথা চালু থাকলে হিন্দি মাতৃভাষার সঙ্গে আর মাত্র ১১টি মাতৃভাষার নাম আমরা পেতাম, বাকি ৮৫টি মাতৃভাষাই নামহীন হয়ে ‘অন্যান্য’ হয়ে যেত। তাই ১৯৯১-এর এই ‘অন্যান্য’ ভাষা-র উল্লেখ ভাষাবিদদের হাতে এক চরম ক্ষমতা এনে দিল। এই সমীক্ষাতেই ৪৮টি মাতৃভাষা ও ন্যূনতম ৪৬৫টি (অন্যান্য ৪৬,৪২,৯৬৪ জন) অর্থাৎ ন্যূনতম ৫১৩টি মাতৃভাষা নিয়ে গঠিত হল অষ্টম তফসিলভুক্ত ‘হিন্দি’ ভাষা। সেই সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ২০০১ সালের সমীক্ষায় ৪৯টি নামযুক্ত মাতৃভাষা আর ন্যূনতম ১৪৭৮টি (অন্যান্য ১,৪৭,৭৭,২৬৬ জন) নামহীন মাতৃভাষা এবং ২০১১ সালের সমীক্ষায় ৫৬টি নামযুক্ত ও ১৬৭২টি (অন্যান্য ১,৬৭,১১,১৭০ জন) নামহীন অর্থাৎ মোট ১৭২৮টি মাতৃভাষা নিয়ে গঠিত হল রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষা। এই ভাবে ২০১১ সালের সমীক্ষাতে যদিও প্রকৃত হিন্দি মাতৃভাষীদের, ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে, শতকরা হার মাত্র ২৬.৬১, রাষ্ট্রীয় ‘হিন্দি’ভাষীদের শতকরা হার বেড়ে হয়ে গেল ৪৩.৬৩।
এর পর তো দ্বিভাষিক তত্ত্ব আছেই। ভারতের যে কোনও রাজ্যে যদি আপনি হিন্দিকে বাদ দিয়ে ১৭২৭টি ভাষার মধ্যে যে কোনও একটি ভাষা বলতে বা বুঝতে পারেন, তা হলেই আপনি ‘হিন্দি দ্বিভাষিক’। সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে এই ভাবে ‘‘ভারতে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি মানুষ হিন্দি বলতে বুঝতে পারেন’’, কথাটা সাংবিধানিক তকমা পেয়ে গেল। অন্য দিকে হিন্দি মাতৃভাষার ২৬.৬১ শতাংশ বাদ দিলে বাকি ৭৩.৩৯ শতাংশ ভারতীয় তাঁদের মাতৃভাষার গুরুত্ব হারিয়ে ফেললেন।
তাই এ কথা পরিষ্কার যে ভারত সরকার কেবল হিন্দির বিস্তারের জন্য যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, তা কেবলমাত্র হিন্দি মাতৃভাষাভাষীদের জন্যই, বাকি ১৭২৭টি মাতৃভাষার বিস্তার বা উন্নতির জন্য নয়। এই মাতৃভাষাগুলি কেবল ব্যবহৃত হয়েছে শতকরা ৫০ ভাগের বাধা পেরিয়ে যাওয়ার জন্যই, গুরুত্ব পাওয়ার জন্য নয়। এই ভাবেই ১৯৭১ সালের ৩৬.৯৯% ক্রমশ বাড়তে বাড়তে ২০১১-য় ৪৩.৬৩%-এ এসে পৌঁছেছে। আর অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ভাষার জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে মাত্র কত টাকা বরাদ্দ থাকে বা থাকেই না, সেটা তো আপনারা জানেনই। কোনও কোনও রাজ্যের সরকারি ভাষার মর্যাদা পেলেও জাতীয় স্তরে এই ভাষাগুলির কোনও রকম স্বীকৃতি নেই। এই মুহূর্তে ৩০টির মতো ভাষা গোষ্ঠী তাই জাতীয় মর্যাদা পাওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ‘হিন্দি’ ভাষা থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীন একটা ভাষার জাতীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ‘মৈথিলী’কেও এই লড়াই করতে হয়েছিল।
১৯৬১ সালে বাঙালিদের ৪.৬৩% ইংরেজি আর ১.৮২% হিন্দি জানতেন (দ্বিতীয় ভাষা অর্থে)। ইংরেজির ক্ষেত্রে আমরা তখন অন্য সব ভাষাগোষ্ঠীর থেকে অনেকটাই এগিয়ে। একমাত্র তামিলেরা আমাদের কাছাকাছি। ২০১১ সালের সমীক্ষায় ছবিটা গেল পাল্টে— কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে সেই ইংরেজির ক্ষেত্রেই আমরা হয়ে গেলাম সর্বনিম্ন ৪%। তামিলরা হয়ে গেলেন ১৮%। এমনকি হিন্দিভাষীদের ইংরেজি জানার শতকরা হার (৬.০৬%) এখন আমাদের থেকে বেশি। তবে হিন্দিভাষীদের একটা সুবিধে হচ্ছে ওঁদের অন্য কোনও দেশীয় ভাষা তেমন গুরুত্ব দিয়ে শিখতে হয় না। যেমন ১৯৬১ সালে হিন্দিভাষীদের ০.৩২% -এর বাংলা জানলেই চলত। ২০১১ সালের সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে আমরা বাঙালিরা হিন্দি শেখার বেলায় যখন ৮.৬২%-এ পৌঁছে গিয়েছি, ওঁরা একটু বেড়ে ০.৫৫% হয়েছেন। আসল কথা, অন্য ভাষাভাষীদের উপায় নেই, তাঁদের শিখতেই হয়— যেমন অহমিয়াদের ১৬%, গুজরাতিদের ৩৯%, পঞ্জাবিদের ৪৬%, মরাঠিদের ৪১% হিন্দি জানেন। হিন্দিভাষীরা কেবলমাত্র ইংরেজি ভাষাটিকেই শতকরা ৬ হারে শিখেছেন, অন্য কোনও ভাষা নয়। সংখ্যাধিক্যের জন্য ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য, এই স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে কেবলমাত্র হিন্দি মাতৃভাষীরাই এই সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
তাই বলতেই হচ্ছে যে, এমনিতেই ‘ইংরেজি’ জানা মানুষেরা ‘প্রথম শ্রেণি’-র নাগরিক আর ‘হিন্দি’ জানা মানুষ কোথাও ‘প্রথম শ্রেণি’, আবার কোথাও ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’-র নাগরিক। দেশের ৭৩.৩৯% কি তা হলে ‘তৃতীয় শ্রেণি’-র নাগরিক? এই প্রশ্ন উঠবেই। আমরা কি প্রাণভরে বলেই যাব ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি ওদের ভাষা’?
তাই মাতৃভাষার স্বাধীনতার অধিকারের সঙ্গে সাংবিধানিক অধিকারের সম্পর্ক কী হবে, সেটা বুঝে নেওয়ার সময় কিন্তু এসে গিয়েছে।
‘মাতৃভাষা: ইংরেজি ভাষা: হিন্দি ভাষা’— এই অনুপাতের মান কত হবে? এই অঙ্কটি সমাধান করাটাই এখন আমাদের আশু কর্তব্য। না হলে ‘ভাষিক-নাগরিকত্ব’ বলতে ভারতে আর কিছুই থাকবে না। এ ক্ষেত্রে হিন্দিভাষীদের অসুবিধে নেই— তাঁদের ওই অনুপাতের অঙ্কটির সমাধানও করতে হবে না। তাঁদের কাছে বিষয়টি কেবল ‘মাতৃভাষা : ইংরেজি ভাষা’। বাকি ৭৩.৩৯% ভারতবাসীদের লড়াইটা লড়তে হবে, তাঁদেরও অনুপাতের অঙ্কটিকে সহজ করে ‘মাতৃভাষা : ইংরেজি ভাষা’ করতে হবে।
আমরা যদি একটু মনে রাখি যে, ইংরেজি শেখা আর ‘ইংরেজিতে’ শেখা এক কথা নয়, তা হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটা কাজে লাগবে: ‘‘রাষ্ট্রিক কাজের সুবিধা করা চাই বই-কি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কাজ দেশের চিত্তকে সরস সফল ও সমুজ্জ্বল করা। সে কাজ আপন ভাষা নইলে হয় না। দেউড়িতে একটা সরকারি প্রদীপ জ্বালানো চলে, কিন্তু একমাত্র তারই তেল জোগাবার খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না।’’
ছবি: বিল্বনাথ চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy