ভাষা দিবসে দেওয়াল চিত্র। ঢাকায়। ছবি: লেখক
বাংলা ভাষা আর একুশে ফেব্রুয়ারি মিলেমিশে একাকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন জব্বর, বরকত, রফিক, সালাম-সহ অনেকেই। তঁারা ভাষা শহিদের সম্মানে দুই বাংলার বুকের গভীরে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের বাংলাদেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশের পাশাপাশি এই বাংলাতেও যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হয় ভাষা শহিদ স্মরণের এই দিনটি। কিন্তু ২০২০ সালের একুশের ভোরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শহিদ মিনারে উপস্থিত থেকে অনুভব করা গেল বাংলা ভাষা নিয়ে কতটা আবেগ বুকে জড়িয়ে রেখেছে এই দেশটি। গভীর রাত্রি থেকে সারাটা দিন লক্ষাধিক মানুষ শ্রদ্ধা আর প্রণামের ফুল নিয়ে ছুটে আসেন শহিদ মিনারে। আজও তঁাদের দাবি বাংলাভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা।
অথচ বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আক্ষেপের শেষ নেই। বাংলা ভাষার অক্ষরগুলি যেন আজ সত্যিই “দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার”... আজ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, সাধারণ, অতি সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েরাও যাচ্ছে ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়ে। বাংলা বর্ণমালা তাদের কাছে অচেনা অক্ষর। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা অক্ষরমালা। আজকের ফেসবুক, মোবাইল আক্রান্ত প্রজন্ম এই ভাষার কতটা কাছাকাছি তা প্রশ্ন থেকেই যায়?
সেই স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলের কাছেই শহিদ মিনার। ভাষা দিবসের কাকভোর থেকেই অগণিত মানুষের ভিড়। সবার হাতে ফুল, মালা। ভাষা শহিদ স্মরণে গানের সুরে তঁারা ভরিয়ে দেন চতুর্দিক। ভাষা শহিদ স্মরণে কবিতার পঙক্তি উচ্চারিত হয় তঁাদের কন্ঠে। সুশৃঙ্খল পদযাত্রায় পায়ে পায়ে তঁারা পৌঁছে যান শহিদ মিনারের কাছে। ভাষা শহিদদের স্মরণে তৈরি করা হয় জব্বর তোরণ, বরকত তোরণ, রফিক তোরণ, সালাম তোরণ। সেইসব তোরণ ছুঁয়ে পৌঁছে যাওয়া শহিদ মিনারের একদম সামনে। দু’ধারের প্রতিটি দেওয়াল চিত্রিত করা হয়েছে রং-তুলিতে। সেখানে লেখা আছে বাংলা ভাষাকে অন্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার আকুল আকুতি। সেই মাটি ছুঁয়ে বুক উথালপাথাল করে মাতৃভাষার জন্য। আবেগ উথলে ওঠে আমাদের বুকের ভাষা, মুখের ভাষা বাংলা ভাষার জন্য। ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষই এ দিন শহিদ মিনার চত্বরে উপস্থিত। বাংলাদেশের সর্বত্র এই দিনটি উদযাপিত হয় মর্যাদা সহকারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক আয়োজনে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবের দিন। বাংলাদেশের মন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই আসেন এখানে। ফুলের স্তবকে আর শ্রদ্ধার মালায় সমস্ত জায়গাটি যেন ফুলের জলসাঘর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা, জনপ্রতিনিধিরা এখানে আসেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের বার্তাবাহী পতাকা উড়িয়ে। সব পতাকা কিন্তু বাংলা হরফে লেখা। বাংলাদেশের সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, সব দোকান, হাট বাজারের নাম বাংলা অক্ষরে লেখার রীতি। তাঁরা মানেন। অথচ আমরা কি বাংলা অক্ষরকে সেই মর্যাদা দিতে পেরেছি? আমাদের এই বাংলায় রাস্তার দু’দিকের দোকানপাট, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগুলির মধ্যে কতগুলি বাংলা অক্ষরে লেখা? আমাদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা ভাষার প্রতি কতটা আগ্রহী করে তুলতে পেরেছি আমরা? এইরকম একটা সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারির ঢাকার শহিদ মিনারের কাছে লক্ষ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে হৃদয় মন সব ভরে ওঠে আশ্চর্য আবেগে।
কী চেয়েছিলেন জব্বর, বরকত রফিক, সালামরা? চেয়েছিলেন মাতৃভাষার মর্যাদা। প্রতিবাদ করেছিলেন মাতৃভাষার অবমাননার বিরুদ্ধে।তার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল তঁাদের ঢাকার রাজপথে।মাতৃভাষা তো আমাদের হৃদয়ের অন্তরতম ভালবাসা। সেই কোন সুদূর অতীত থেকে এই ভাষা আমাদের অন্তরে জড়িয়ে। তবু মাতৃভাষার জন্য আক্ষেপ আর হতাশা বাড়ছে আমাদের। বাংলা মাধ্যমে পড়ার বিদ্যালয়গুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। যখন ‘আমার আবার বাংলাটা ঠিক আসে না’ বলতে আমরা অনেকেই গর্ববোধ করি, যখন নতুন প্রজন্ম বাংলা কবিতা ভুলে ইংরেজি রাইমস বলে প্রশংসা কুড়োয় তখন একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে বাংলাদেশের শহিদ মিনার অঙ্গণে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এমন মধুরতম ভাষাকে ভালবাসায় আমাদের অনেক ত্রুটি থেকে গিয়েছে কোথাও। তাই ভালবাসতে হবে বাংলাভাষাকে। এ আমাদের দায়বদ্ধতা।
ভাবতে গর্ব হয়, বাংলা আমাদের সেই ভাষা যে ভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়া যায়। বাংলা আমাদের সেই ভাষা যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন, জীবনানন্দের কলমে বিশ্বসাহিত্যকে চমকে দেওয়ার মত সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়, সেই ভাষাকে আরও গভীর ও নিবিড়ভাবে হৃদয়ের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে। আগামী প্রজন্মকে চিনিয়ে দিতে হবে সেই ভালবাসার অক্ষরমালা। নাহলে যে ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ হয়েই থেকে যাবে আমাদের মাতৃভাষা।
লেখক সাহিত্যকর্মী, প্রাক্তন কলেজ গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy