Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভিতরের লড়াই

বিপদ এই কারণে গুরুতর যে, রাষ্ট্রনীতি নিজেই মেরুকরণের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হইতেছে। নূতন নাগরিকত্ব আইন মেরুকরণের জমি তৈয়ারি করিয়াছে, সেই জমিতে অতঃপর জাতীয় নাগরিক পঞ্জির ইমারত গড়া হইবে।

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২০ ২৩:৫৪
Share: Save:

একটি লড়াইয়ের ভিতরে আর একটি লড়াই চলিতেছে। বাহিরের লড়াই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে, দেশ জুড়িয়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) প্রবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। ভিতরের লড়াই চলিতেছে ওই বাহিরের লড়াইয়ের সংজ্ঞা, ধর্ম এবং গতিপথকে কেন্দ্র করিয়া। সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন যাহাতে কেবলমাত্র মুসলমান সমাজের আন্দোলনে পর্যবসিত না হয়, ভিতরের লড়াই সেই উদ্দেশ্যে। ভিতরের লড়াইয়েই নিহিত রহিয়াছে বাহিরের লড়াইয়ের প্রাণশক্তি। সেই লড়াই ব্যর্থ হইলে ওই প্রাণশক্তি বিনষ্ট হইবে। তাহা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নহে, বিপজ্জনক। সেই বিপদ অত্যন্ত বড় আকারের, কারণ তাহা ভারতীয় রাজনীতিকে আড়াআড়ি ভাগ করিয়া দিতে পারে, রাজনীতির মেরুকরণ ষোলো আনা সম্পন্ন করিয়া মেরুকরণকেই রাজনীতিতে পরিণত করিতে পারে। এত বড় বিপদ স্বাধীন ভারতে আগে কখনও আসে নাই।

বিপদ এই কারণে গুরুতর যে, রাষ্ট্রনীতি নিজেই মেরুকরণের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হইতেছে। নূতন নাগরিকত্ব আইন মেরুকরণের জমি তৈয়ারি করিয়াছে, সেই জমিতে অতঃপর জাতীয় নাগরিক পঞ্জির ইমারত গড়া হইবে। একটি কথা বুঝিয়া লওয়া আবশ্যক। সিএএ সত্যই কত ‘নিপীড়িত হিন্দু’কে নাগরিকত্ব দিবে এবং নাগরিক পঞ্জিতে শেষ অবধি কত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র নাম বাদ পড়িবে ও তাঁহাদের গতি কী হইবে, তাহা কেহ জানে না, শাসকেরাও জানেন না। কিন্তু, অনুমান করা সহজ, তাঁহাদের জানিবার প্রয়োজনও নাই। সিএএ দেখাইয়া হিন্দুদের অভয় দিয়া যদি তাঁহাদের বলা হয় যে, এনআরসি-র ঔষধ দিয়া ‘অবাঞ্ছিত’দের বিতাড়ন করা হইবে এবং সেই ব্যবস্থাপত্রে যদি তাঁহারা সন্তুষ্ট হন, তাহা হইলেই কার্য সিদ্ধ হইবে। এই হিসাবটি পরিষ্কার বলিয়াই বোধ করি নাগরিকত্ব আইন বলবৎ করিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন ধনুর্ভঙ্গ পণ— বিরোধীরা সকলে একযোগে আপত্তি করিলেও সিএএ-র বিষয়ে এক ইঞ্চি পিছু না হটিবার হুমকি।

নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন মুসলমানের আন্দোলন হইয়া উঠিলে মেরুকরণের পথ সুগম হইত। আশ্বাসের কথা, তাহা হয় নাই। এই আন্দোলন একটি বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের রূপ লইয়াছে। দেশ জুড়িয়া এই প্রতিবাদে সংখ্যালঘু মানুষের ভূমিকা অবশ্যই প্রবল। তাহা অত্যন্ত স্বাভাবিক— যাঁহারা গোষ্ঠী হিসাবে বিপন্ন বোধ করিতেছেন তাঁহারা গোষ্ঠী হিসাবেই প্রতিরোধে নামিবেন। কিন্তু দুই দিক হইতে এই আন্দোলন গোষ্ঠীর সীমা অতিক্রম করিয়াছে। এক, সংখ্যালঘু সমাজের বাহির হইতেও অগণিত মানুষ গণতন্ত্র তথা সংবিধানকে রক্ষার তাগিদে জনপথে দাঁড়াইয়া ‘উই দ্য পিপল...’ পাঠ করিয়াছেন। সংখ্যালঘুর স্বার্থ কেবল সংখ্যালঘুকেই দেখিতে হইবে— এই জিন্না-ধর্মী সঙ্কীর্ণ মন্ত্র উড়াইয়া দিয়া সমস্বরে ঘোষণা করিয়াছেন: হম দেখেঙ্গে! মেরুকরণের কারিগরদের মুখের উপর ইহা এক প্রচণ্ড জবাব। দুই, সংখ্যালঘু মানুষও তাঁহাদের প্রতিবাদকে গোষ্ঠীস্বার্থের গণ্ডিতে বাঁধিয়া রাখেন নাই, তাহার উত্তরণ ঘটাইয়াছেন বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। শাহিনবাগের রাজপথে শুক্রবার একটি মিছিল হইতে ধর্মীয় স্লোগান উঠিলে সেখানকার ঐতিহাসিক সমাবেশের আয়োজকরাই আপত্তি করিয়াছেন এবং স্লোগানদাতারা তৎক্ষণাৎ ভুল স্বীকার ও সংশোধন করিয়াছেন, স্লোগান বদলাইয়াছে। দুই দিক হইতেই সম্মানিত হইয়াছে গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত: সংখ্যালঘুর অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করা সংখ্যাগুরুর নৈতিক দায়িত্ব। সংখ্যাগুরুবাদের প্রবক্তা ও সেনাপতিরা এই শর্ত মানেন না। মানিতে পারেন না। মানিলে মেরুকরণের প্রকল্পটি ধসিয়া পড়ে। সেখানেই সংখ্যাগুরুবাদের সহিত গণতন্ত্রের লড়াই। ভিতরের লড়াই।

অন্য বিষয়গুলি:

CAA NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy