অমিত্র-ভজনা: চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-কে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আপ্যায়ন, সেপ্টেম্বর ২০১৪, যদিও দুই দেশের মৈত্রী প্রয়াস এখনও চূড়ান্ত অসফল।
অসমের কড়া চা খেতে ভালবাসেন নরেন্দ্র মোদী। বহু বছরের অভ্যাস। হুট করে এ অভ্যাস বদলানো তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন। ভারতের মতো এক বিশাল দেশের বিদেশনীতিও আচমকা বদলে ফেলা কঠিন। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর দুনিয়ার পরিস্থিতিতে কোনও বড়সড় রদবদল না হলে বিদেশনীতিতে পরিবর্তনের নয়া যাত্রাপথ তৈরি হয় না। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কানাডার প্রবীণ কূটনীতিক ডেভিড ম্যালোন জানতে চেয়েছিলেন, এ বার কি তবে ভারতের হাতি নাচবে? জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ছেলে শৌর্য এখন সরকার-সমর্থক এক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রধান। জবাবে বলেছিলেন, মোদী হাতির বদলে সামনে এনেছেন সিংহ, যে ক্ষিপ্র ও দ্রুতগামী।
এ সব কথা শুনতে বেশ ভাল লাগে। গত তিন বছর ধরে যেমন বিজেপি-র বিদেশ বিভাগীয় শাখা প্রচার করছে, ‘মোদী ডকট্রিন’। প্রধানমন্ত্রী বদলালেই কি ডকট্রিন বদলে যায়? ১৯৬২ সালে চিন আক্রমণের পর ভারতের বিদেশনীতির প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি হয়। তবে ইন্দিরা যুগেও বিদেশনীতি সেই সাবেকি জোট নিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী নেহরু-পথ ধরেই হেঁটেছে। কিছু কূটনীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, ১৯৬৪ সাল থেকে ’৯১ সালের দীর্ঘ সময়ে ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী ভারসাম্যের কূটনীতি পর্ব। কিন্তু কংগ্রেসবিরোধী জোট যুগে যতই ‘গুজরাল ডকট্রিন’কে বামপন্থীরা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করুন, বাস্তবে ভারতের বিদেশনীতিতে সে রকম কোনও চাঞ্চল্যকর সাফল্য বা নয়া মোড় দেখা যায়নি। ’৯১ সালে নরসিংহ রাও জমানায় বিশ্বজোড়া আর্থিক সংস্কারের হাওয়ায় বিদেশনীতিতে মস্কো-আধিপত্য অতিক্রম করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক কূটনীতির এক নবপর্যায় শুরু হয়। চিন শুধু নয়। ইজরায়েলের উপর থেকেও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন রাও।
মোদী এসেই যে ভাবে ঘন ঘন বিদেশযাত্রা শুরু করেন, তার যতই সমালোচনা দেশের ভিতর হোক, কূটনীতিক মহল কিন্তু তাতে বেশ খুশিই হয়। কাছ থেকে মানুষটিকে দেখার সুযোগ হয়েছে, দেখেছি কী ভয়ংকর পরিশ্রম করতে পারেন মোদী। প্রত্যহ সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠেন। ঘুম থেকে ওঠার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি আই প্যাডের সব বার্তা নিজে চেক করেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে যোগ ও নানা ধরনের ব্যায়াম করেন। চা-ওয়ালার ছেলে হয়েও বিদেশের নানা প্রান্ত সম্পর্কে তাঁর ধারণা যথেষ্ট স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেও তিনি দীর্ঘ সময় আমেরিকায় অনাবাসী গুজরাতিদের নিয়ে কাজ করতেন। তখন থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে আগ্রহ। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ নামক বাণিজ্য-সম্মেলনের মঞ্চকে ব্যবহার করে পৃথিবীর নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে তো মোদীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আমদাবাদে তিনি প্রচুর গল্ফ কোর্স তৈরি করেন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে। আমাকে বলেছিলেন, ‘এর আসল কারণ কী জানো? জাপানি ব্যবসায়ীদের গল্ফের প্রচণ্ড নেশা। এখানে এসে প্রধানমন্ত্রীও গল্ফ খেলেন।’ সে জন্য মোদী নিজেও গল্ফ খেলতে শুরু করেন।
এ হেন সক্রিয় মোদী এসেই বলেন, ‘প্রতিবেশী–প্রথম’ নীতি নেবেন তিনি। ২৬ মে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানালেন সে বার্তা দিতে। কিন্তু চিনকে না ডেকে নির্বাসিত তিব্বতের প্রধান লোবসাং সাংগে আর দলাই লামাকে ডাকলেন। চিন ক্ষিপ্ত হল। তার পর চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজে পাল্টা উৎসাহ দেখিয়ে ভারতে মোদীর প্রথম অতিথি হয়ে এসে সবরমতীর তীরে দোল খেলেন একই ঝুলায় বসে।
এর পর তিন বছর অতিবাহিত। কী দেখছি আমরা? ভুটান ছাড়া প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, এখন তো বাংলাদেশেও ড্রাগনের নিঃশ্বাস। চিনের কাছে অন্য দেশে বিনিযোগের জন্য যে টাকা ও অগ্রাধিকার আছে, ভারতের তা নেই। তা হলে আমাদের রণকৌশল কী? পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা যতই কঠোর কূটনীতির পথে হাঁটছি, চিন ও পাকিস্তানের সখ্য ততই বাড়ছে। ট্রাম্পের পাকিস্তান ও মুসলিমবিরোধী বক্তব্যে বিজেপির অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ কিঞ্চিৎ বেড়ে যায়, ট্রাম্প-পুতিন সম্পর্কের মূল্যায়নেও ভুল হয়, আর এখন বোধোদয়— রাশিয়া আসলে তলে তলে চিন-পাকিস্তান অক্ষে সক্রিয়। সিরিয়া নিয়েও যে আমরা ঠিক কী করব তা স্থির করতে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের সঙ্গেও তিস্তা চুক্তি করতে যদি মোদী না পারেন, তবে কোন মুখে মনমোহন সরকারের ডেলিভারি-ব্যর্থতার কথা বলবে এই সরকার? মোদীর বিদেশনীতির ডেলিভারি ডেফিসিট কি কম? আসলে মোদীর প্রয়াস প্রচার পেলেও বিদেশনীতির লক্ষ্যটা কী, সেটা আজও অস্পষ্ট। নানা স্তরের স্ববিরোধে আক্রান্ত।
২০১৪ সালে দেখেছি মোদীর প্রচারের কৌশলের আধুনিকতার মূল অস্ত্র ছিল বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও তিনি এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের সুপারম্যান নরেন্দ্র মোদী হিসাবে বাজিমাত করবেন ভেবেছিলেন। সমস্যা, সেটা যতটা আঙ্গিকের অপটিকস, সারবত্তার নিষ্ঠা ততটা নেই। মোদী আর্থিক উন্নয়ন আর প্রতিরক্ষা দু’টি ক্ষেত্রেই কূটনৈতিক সক্রিয়তা বাড়াচ্ছেন। বার্তা দিচ্ছেন, হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে ভারত কারও চেয়ে কম যায় না। কিন্তু দেশের ভিতর উগ্র হিন্দুত্ব আর হিন্দু রাষ্ট্রগঠনের ভাবনা মোদীর বিদেশনীতিতে কি কালো ছায়া ফেলছে না? আমেরিকা রাশিয়া চিন— কোন পথে যে আমরা চলতে চাইছি তা মোটেই স্পষ্ট নয়।
নেহরুর মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ বিদেশি সাংবাদিক জেমস ক্যামেরন লিখেছিলেন, ‘আমি নেহরুকে কতটুকু জানি। তিনি নিজেই বলতেন আমি কি আমাকে সবটা জানি। যা করি অনেক সময় নিজেই তার সমালোচনাও করি। মনে হয় ভুল করেছি।’ মোদী যদি এমন আত্মবিশ্লেষণে ব্রতী হতে পারেন, তিনিও বুঝতে পারবেন তাঁর এ দেশকে স্বচ্ছ করার অভিযানও যেমন ব্যর্থ হয়েছে, জঞ্জাল আবর্জনা মুক্ত হয়নি এ দেশ, ঠিক সেই ভাবেই তাঁর বিদেশনীতিও অস্বচ্ছতার শিকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy