Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
India-China Conflict

চিনকে বিশ্বাস করা যায় না, আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে আরও ভাবতে হবে

গালওয়ান উপত্যকা ঘিরে ভারত-চিন সম্পর্কের কতটা অবনতি? আজ চতুর্থ তথা শেষ পর্বপ্রাচীন চিনা যুদ্ধশাস্ত্র সান জু ‘আর্ট অফ ওয়ার’-এ একটি অধ্যায় ‘আকস্মিকতা এবং ভাঁওতা’। সেই কৌশল মেনেই লাদাখে আচমকা আঘাত হেনেছে চিন।

লাদাখে ভারতীয় সেনার টহলদারি। ছবি: এএফপি

লাদাখে ভারতীয় সেনার টহলদারি। ছবি: এএফপি

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে আর মুখোপাধ্যায়
অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২০ ১৭:৩০
Share: Save:

শেষ পর্বের লেখার গোড়াতেই একটা কথা বলে রাখা ভাল, সরকারি কার্যকলাপে নাক গলানোর কোনও চেষ্টা আমি করছি না। ভারতীয় সেনার যে অফিসার এবং জওয়ানেরা অদম্য সাহস এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করে চলেছেন, তাঁদের সাফল্যের ভাগও চাইছি না। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য, সীমান্ত সমস্যা আরও ভাল ভাবে উপলব্ধি করার জন্য জনসচেতনতা গড়ে তোলা।

নিবন্ধের আগের তিনটি অংশে ভারতের উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মলদ্বীপ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কাকে কাছে টানতে চাইছে চিন, সে কথাও তুলে ধরা হয়েছে। সম্পর্কের এই টানাপড়েনের মধ্যেও কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারত-চিন বাণিজ্য লক্ষণীয় ভাবে বেড়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই অগ্রগতির প্রতিফলন লাদাখ কিংবা সিকিম-ভুটান সীমান্তে দেখা যায়নি। রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক দিক থেকে মুখ ফিরিয়েই চিন তার পদক্ষেপ করে চলেছে।

ডোকলামে মুখ পোড়ানোর পরে, ভারতের তরফে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে চিন সতর্ক হয়েছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বৃদ্ধির সাফল্য এবং আর্থিক ও সামরিক শক্তিবৃদ্ধি তাকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। শক্তির ভারসাম্য ক্রমশ পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যের দিকে ঝোঁকার লক্ষণ দেখছে চিন। আর তাই লাদাখে এমন পদক্ষেপ করতে উৎসাহী হচ্ছে। আর্থিক মন্দা এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ভারতের অবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এমন একটা সময়কেই লাদাখে আগ্রাসী আচরণের জন্য বেছে নিয়েছে চিন।

লাদাখে ভারতীয় সেনার ব্যানার— ফাইল চিত্র।

এ বার একটু অন্য রকম ভেবে দেখা যাক। সান জুর লেখা প্রাচীন চিনা যুদ্ধশাস্ত্র, ‘আর্ট অফ ওয়ার’-এ একটি অধ্যায় ‘আকস্মিকতা এবং ভাঁওতা’ (সারপ্রাইজ অ্যান্ড ডিসেপশন)। সেই কৌশল মেনেই লাদাখে আচমকা আঘাত হেনেছে চিন। ভারত তার কৌশলগত স্বার্থ পূরণের পথে অন্তরায় হয়ে উঠছে। তাই এ ভাবে হঠাৎ চড়াও হয়ে তাকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করছে।

আরও পড়ুন: ভারত-চিন বিরোধের গোড়ায় তিব্বত, তার পরে জল গড়িয়েছে নানা দিকে

আমাদের সেনারা সীমান্তে সফল ভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে কারও সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তব হল, অতীতে কার্গিল এবং এ বার লাদাখ, ভারত ফের আকস্মিক আঘাতের শিকার হল। চিন ধীরগতিতে ‘সালামি স্লাইসিং’ পদ্ধতিতে আমাদের ভূখণ্ড দখল করতে চাইছে। গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টি এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। তাই এ ভাবে আকস্মিক আঘাতের শিকার হওয়ার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। বরং কাম্য ছিল, পিএলএ-র প্রস্তুতির বিষয়ে আমাদের কাছে আগাম খবর থাকবে। তার মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সেনা মোতায়েন এবং অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এমনটা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তরফে কোনও অবহেলা ছিল কি না, তা তদন্ত করে দেখা উচিত।

আরও পড়ুন: গালওয়ানে বর্তমান অবস্থান বজায় থাকলে কিন্তু ফায়দা চিনেরই

হিমালয়ের উঁচু পাহাড় ঘেরা অঞ্চলের দখল এক বার হাতছাড়া হয়ে গেলে, তা ফিরিয়ে আনার বিনিময়ে বড় ধরনের প্রাণহানি অনিবার্য। পূর্ব লাদাখের বর্তমান পরিস্থিতি কার্গিলের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক। চিনা ফৌজ যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা উঁচু এলাকায় ঘাঁটি গড়েছে। ফলে চুক্তি অনুযায়ী তারা পিছিয়ে না গেলে, জায়গাগুলি পুনরুদ্ধার করা কঠিন। তবে আলোচনা বা অন্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যদি চিন স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে রাজি না হয়, ভারতীয় সেনাকে পাল্টা আঘাত হানতেই হবে। গালওয়ান উপত্যকার পরিস্থিতি সত্যিই উদ্বেগজনক। কারণ, চিনারা এখানে সদ্য নির্মিত শিয়োক-দৌলত বেগ ওল্ডি সড়কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সড়ক কৌশলগত ভাবে ভারতীয় সেনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনা ফৌজ ঢুকে আসার ফলে ভারতীয় সেনার পক্ষে শিনজিয়াংয়ের অন্দরে আঘাত হানার কাজও কঠিন হয়ে গিয়েছে। এলএসি-র অন্য এলাকাগুলিতে অবশ্য প্রত্যাঘাতের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তা করতে গেলে পরিস্থিতি নিশ্চিত ভাবেই আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে।

চিনকে কোনও ভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা আমাদের উপর অতর্কিতে আঘাত হানতেও যথেষ্ট সক্ষম। তাই ভারতের কোনও অবস্থাতেই অপ্রস্তুত থাকা চলবে না। ভবিষ্যতে ফের বিস্মিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে পাল্টা বলপ্রয়োগের জন্য মানসিক এবং সামরিক স্তরে প্রস্তুত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজ তৈরি হওয়া বাফার জোন আগামিকাল ভারতকে আরও বেশি বেকায়দায় ফেলতে পারে।

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় বাহিনীর পেট্রোলিং— ফাইল চিত্র।

সান জুর রণকৌশল অনুসরণ করে চিন গালওয়ান উপত্যকায় ভারতকে কিছুটা চাপে ফেলেছে। সরাসরি যুদ্ধ না করেও তারা দৌলত বেগ ওল্ডিগামী সড়কের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তারা ১৯৬২ সালের মতোই ভারতকে ‘শিক্ষা দেওয়ার’ মতলবে ছিল। যদিও নয়াদিল্লির তরফে তা খোলাখুলি স্বীকার করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি, সীমান্ত সুরক্ষায় যুক্ত ‘ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ’ (আইটিবিপি)-র মতো বাহিনীর ‘অপারেশনাল কমান্ড’ও সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া জরুরি।

পার্বত্য এলাতায় বড় বাহিনী মোতায়েন করে রাখার সুযোগ নেই। ফলে বাহিনীগুলির মধ্যে নিবিড় সমন্বয় প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যে বাহিনীগুলিতে ঢেলে সাজা প্রয়োজন। এমন দীর্ঘ সীমান্তের সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রকৃত পরিস্থিতিটাও ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপলব্ধি করতে হবে। ‘এক ইঞ্চিও জমি হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবে না’, শুধুমাত্র এমন কথাবার্তা দিয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না।

ভারতের বিরুদ্ধে ‘রক্ষণাত্মক মানসিকতা’র অভিযোগ রয়েছে বরাবর। আমরা ইজরায়েলের প্রতিআক্রমণের নীতির প্রশংসা করি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাদের মতো ভূমিকা নিতে পারি না। আর একটা মারাত্মক দুর্বলতাও আমাদের সংশোধন করতে হবে। সাইবার এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে লড়াইয়ের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রটিতে অবিলম্বে অগ্রাধিকার না দিলে চিনের জয়ের সম্ভাবনা প্রবল।

আরও পড়ুন: শুধু লাদাখ নয়, ভারতের আরও অনেক এলাকাই চিনের টার্গেট​

এখানে বিভিন্ন ভাবে প্রচুর ভুল তথ্য ছড়ায়। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেগুলি খণ্ডন করা না হলে ভারতের যাবতীয় পরিকল্পনাই মাঠে মারা যেতে পারে। গুজব ছড়ানোর বর্তমান প্রবণতা ঠেকানো খুবই প্রয়োজন।

আমাদের লক্ষ্য, সীমান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দলাই লামা এবং ভারতে বসবাসকারী তিব্বতিদের বিষয়টিও ভাবনায় রাখা উচিত। পাশাপাশি, লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের আঞ্চলিক ভাবাবেগের বিষয়টি মাথায় রেখে সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। চিন সংক্রান্ত বিদেশনীতি স্থির করার আগে আমাদের সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং সীমান্তে পরিকাঠামো ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একমাত্র সে ক্ষেত্রেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুলতে পারে।

দুঃখজনক ভাবে চিনারা তাদের দাবিকৃত কিছু অঞ্চল দখল করতে সক্রিয় হয়েছে। তার ফলে ভারত এবং আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সমালোচনাও কুড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চিনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপেরও প্রয়োজন রয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প ছাড়া চিনা ফৌজকে পুরোপুরি পিছু হটতে বা সংযত থাকতে বাধ্য করা যাবে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE