গালওয়ানের মতোই সঙ্ঘাতের চোরাস্রোত সামনে এসেছে বারে বারে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
চিনের সঙ্গে ভারতের সমস্যা প্রাথমিক ভাবে তিব্বত কেন্দ্রিক। তিব্বতিদের উপর ধারাবাহিক অত্যাচার চালাচ্ছে চিন। তাদের মূল ধারার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে তিব্বতিদের প্রতি ভারতের সমর্থন এবং দলাই লামা-সহ তিব্বতি শরণার্থীদের সঙ্গে নয়াদিল্লির সুসম্পর্ক নিয়ে চিন বরাবরই সন্দিহান। ১৯০৯ সালে মাঞ্চু সম্রাটের বাহিনী তিব্বত আক্রমণ করার পরেও তৎকালীন দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিন বছর পরে তিনি নিজের দেশে ফিরে চিনাদের তাড়িয়ে তিব্বতে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিলেন। চিন এখনও সেই ইতিহাস মনে রেখেছে। তাই লক্ষাধিক অনুগামী-সহ চতুর্দশ দলাই লামার ভারতে অবস্থান তার কাছে সন্দেহের।
হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় নির্বাসিত তিব্বতি সরকার গঠনে ভারত অনুমতি দিয়েছিল। আগে সেই তিব্বতি সরকারের সঙ্গে আন্ডার সেক্রেটারি স্তরের আধিকারিকের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা হত। কিন্তু দলাই লামার সঙ্গে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের আলোচনার প্রেক্ষিতে তা জয়েন্ট সেক্রেটারি স্তরে উন্নীত করা হয়েছে। নির্বাসিত তিব্বতি সরকারকে নয়াদিল্লির এই স্বীকৃতিকে ‘চিন বিরোধী ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ’ হিসেবেই দেখেন সে দেশের শাসকেরা। নির্বাসিত তিব্বতি ধর্মগুরু ও নেতাদের ধর্মশালায় আলোচনাসভা আয়োজনেরও ছা়ড়পত্র দিয়ে রেখেছে ভারত। চিনের অভিযোগ, ওই সভায় তিব্বতে বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়।
নয়াদিল্লির এই কাজের জবাবে, কড়া ভারত বিরোধী পদক্ষেপও করেছে চিন। ২০০৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অরুণাচল সফরের সময় চিন একতরফা ভাবে সীমান্ত সমস্যা সংক্রান্ত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিল করেছিল। ওই চুক্তিতে সীমান্তের দু’পারের বাসিন্দাদের কোনও অসুবিধা না-করে সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার কথা বলা হয়েছিল। চিনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিচুয়ানে আন্দোলন এবং দিল্লিতে সীমান্ত সমস্যার নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সময় তিব্বতিতের বিক্ষোভ নিয়েও কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বেজিং। ‘মধ্যবর্তী সাম্রাজ্য’ হয়ে উঠতে ব্যাগ্র চিনের কাছে এখন অন্যতম অগ্রাধিকার, তিব্বতকে পুরোপুরি গিলে নেওয়া।
তিব্বতের স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি।
শুধু তিব্বত নয়, দলাই লামা বৃহত্তর তিব্বত অঞ্চলের জন্য স্বশাসনের দাবি জানিয়েছেন। যা চিনের মোট এলাকার প্রায় এক চতুর্থাংশ। আর দলাই লামা স্বশাসনের যে শর্তগুলি দিয়েছেন, তা কার্যত স্বাধীনতার দাবির মতোই। তাঁর সেই দাবিগুলি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মনোযোগ কেড়েছে। ফলে চিন বিচলিত হয়ে পড়েছে। যে কোনও মূল্যে তিব্বতকে দমিয়ে রাখতে চাইছে।
আরও পড়ুন: গালওয়ানে বর্তমান অবস্থান বজায় থাকলে কিন্তু ফায়দা চিনেরই
ভারতের মোকাবিলায় পাকিস্তানকে মদত দিয়ে শিখণ্ডী খাড়া করতে চাইছে চিন। পাকিস্তানের নর্দার্ন এরিয়ায় (গিলগিট-বালটিস্তান) ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যায় চিনা ফৌজ মোতায়েন করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের নিরাপত্তার পক্ষে যা উদ্বেগের। একই ভাবে উদ্বেগের হল— চিনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নীতি’র অন্তর্গত চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর। অরুণাচলের উপর চিনের ক্রমাগত দাবিও ভারতের বিড়ম্বনার কারণ। অভিযোগ, পাকিস্তানের প্রতি চিনের ধারাবাহিক সমর্থনের ফলে ভারতে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি উৎসাহ পাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ এবং নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের প্রবেশের পথেও অন্তরায় হচ্ছে চিন। সে কারণেই আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও কিছু দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চিনের বিরুদ্ধে কৌশলগত বোঝাপড়ায় ভারত সামিল হয়েছে। ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি এবং কৌশলগত অংশীদারিত্ব সেই বোঝাপড়ারই অংশ। ‘লুক ইস্ট’ নীতি থেকে এগিয়ে ভারত এখন ‘অ্যাক্টিং ইস্ট’-এর পথে। দক্ষিণ চিন সাগরের সুরক্ষা উদ্যোগে ভারত অংশ নেওয়ায়, চিনের ওই বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের পথে অন্তরায় হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। উল্টো দিকে, তিব্বতে গঙ্গা (উপনদী) ও ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ দিয়ে তার জলপ্রবাহ নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্রিয় চিন। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জটিল হয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যে। দেরিতে হলেও লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চিনের নজর পড়েছে।
পাকিস্তানের পরমাণু প্রকল্পে ১৯৮০ সালের গোড়া থেকে সহায়তা শুরু করে চিন। পাক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতেও তারা হাত খুলে সাহায্য করেছে। পরমাণু অস্ত্র প্রচাররোধ চুক্তি এবং সার্বিক পরমাণু পরীক্ষা নিরোধক চুক্তি সই করার পরেও বেজিং অকাতরে ইসলামাবাদকে পরমাণু অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি দিয়ে চলেছে। ১৯৯৪ সালে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাবিধি ছাড়াই চিন ‘রিং ম্যাগনেট’ সরবরাহ করেছিল পাকিস্তানকে। পরমাণু অস্ত্র বানানোর জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজে যা ব্যবহৃত হয়। চাশমার দু’টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রও চিনের সাহায্যেই তৈরি হয়েছে। বস্তুত, চিনা নকশা অনুসরণ করেই চলে পাক পরমাণু কর্মসূচি। তাই নর্দার্ন এরিয়ায় আজ চিনের সমর্থনে বিপুল পাক ফৌজের সমাবেশ।
শিনজিয়াংয়ের কাশগড় থেকে বালুচিস্তানের গ্বাদর পর্যন্ত বিস্তৃত চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর।
চিনের শিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে শুরু হয়ে কারাকোরাম হাইওয়ে ঢুকেছে পাকিস্তানের গিলগিট-বালটিস্তানে। ১৩০০ কিলোমিটারের রাস্তা শেষ হয়েছে বালুচিস্তান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের গ্বাদর বন্দরে। সুদীর্ঘ বাই-লেন মহাসড়কের পোশাকি নাম চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)। এই সুদীর্ঘ সড়ক পথ চিনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির অন্যতম অঙ্গ। চিনই তার ‘আরব সাগরের প্রবেশরপথ’ গ্বাদর বন্দরটি তৈরি করেছে। শিনজিয়াংয়ের সঙ্গে সমুদ্রপথের যোগাযোগের উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্প। এর মধ্যে রয়েছে রেলপথ নির্মাণ এবং ইরান থেকে গ্যাস আনার পাইপলাইন স্থাপন। কারাকোরাম হাইওয়ের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র-সহ নানা নিষিদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ শুরু করেছে চিন। এই পথেই পাকিস্তান থেকে উত্তর কোরিয়ায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সরঞ্জাম পৌঁছেছে বলেও জানা গিয়েছে। নয়াদিল্লির আপত্তি উপেক্ষা করেই সিপিইসি’র মাধ্যমে পাকিস্তানের নর্দার্ন এরিয়া এবং অধিকৃত কাশ্মীরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে চিন। ফলে ভারতের আর্থিক এবং কৌশলগত স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে।
তিব্বতে জলের উৎসগুলিতে চিনের দখলদারিও ভারতের কাছে খুবই উদ্বেগের। ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি নদীর উৎপত্তির সঙ্গে তিব্বত জড়িত। ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু এবং গঙ্গার (ঘর্ঘরা, কোশী-সহ একাধিক উপনদীর) জলের উৎস এখানেই। চিন সেখানে বাঁধ বানিয়ে ‘দক্ষিণ থেকে উত্তরে জল স্থানান্তরের’ কাজ শুরু করেছে। তিব্বত থেকে সেই জল নিয়ে গিয়ে চিনের উত্তরের শুষ্ক অঞ্চলে কৃষি এবং শিল্পের কাজে ব্যবহার করা হবে। এর ফলে ভারতের নদীগুলিতে জলের পরিণাম কমবে। ব্রহ্মপুত্রের উৎসে চিনা বাঁধ নির্মাণের ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশে তীব্র প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রকল্পের কারণে নিম্ন অববাহিকার দেশ ভারতকে জল পাওয়ার জন্য বেজিংয়ের মর্জির উপর নির্ভর করতে হবে। যা জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার পক্ষে বড় আশঙ্কার কারণ। ভবিষ্যতে এর ফলে সঙ্ঘাতের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
দক্ষিণ চিন সাগরে চিনা রণতরী— ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশ, মায়ানমার, মলদ্বীপ, পাকিস্তান এবং আফ্রিকা ও আসিয়ানভুক্ত বিভিন্ন দেশে চিন তার নৌবাহিনী মোতায়েন করতে সক্রিয়। ভারতের সমুদ্র নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। সমুদ্রপথে ভারতে ঘিরে ধরার এই চিনা কৌশল ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’ (মুক্তোর মালা) নামে পরিচিত। চিন তার জ্বালানি সরবরাহের পথ সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌসেনার প্রভাব ঠেকাতে সমুদ্রপথে ভারতকে ঘিরে ধরার এই কৌশল নিয়েছে। চিনা নৌবাহিনীর এই তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে ভারতের কৌশলগত, ভৌগলিক, আর্থিক এবং জ্বালানি সরবরাহ সংক্রান্ত স্বার্থ সরাসরি জড়িত।
আরও পড়ুন: শুধু লাদাখ নয়, ভারতের আরও অনেক এলাকাই চিনের টার্গেট
চিনের এই কৌশলের জবাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সংযুক্ত কম্যান্ডকে সক্রিয় করে তুলছে নয়াদিল্লি। পোর্ট ব্লেয়ারে নৌশক্তি বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানি তেল সরবরাহের সমুদ্রপথ সুরক্ষিত করার জন্য ভারতীয় নৌসেনার যুদ্ধজাহাজ ও বিমানগুলি ইন্দোনেশিয়া, তাইল্যান্ডের মতো দেশের সঙ্গে যৌথ টহলদারিও শুরু করেছে। চিনের জ্বালানি সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ পথ মলাক্কা প্রণালী। সে দেশের পশ্চিম উপকূল থেকে চিন সাগর, মলাক্কা প্রণালী ধরে ভারত মহাসাগর হয়ে আফ্রিকা উপকূল ও পশ্চিম এশিয়া এমনকি, সুয়েজ খাল ধরে ইউরোপে পৌছানোরও সমুদ্রপথ এটি। মলাক্কা প্রণালীতে প্রভাব বাড়াতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করতে সক্রিয় চিন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনও দেশের সঙ্গে বেজিংয়ের এমন উদ্যোগ এই প্রথম। চিনা সামরিক কৌশলের নতুন অঙ্গ হল ‘সুদূর সমুদ্রপথের নিরাপত্তা’। দূরপাল্পার নৌ-সক্ষমতা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য, পারস্য উপসাগর থেকে মলাক্কা প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। চিনা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে বাণিজ্য-তরীগুলির যাতায়াতের পথে সমস্ত বাধা দূর করা। এই কৌশল কার্যকরী হলে দক্ষিণ এবং পূর্ব চিন সাগরের প্রাকৃতিক সম্পদের উপরেও চিনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
নিবন্ধের তৃতীয় অংশ এখানেই শেষ। চতুর্থ তথা শেষ অংশে আলোচনা করব সমস্যা সমাধানে ‘করণীয়’ প্রসঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy