আমাজন জ্বলছে। অনিয়ন্ত্রিত দাবানলে ছ’কোটি বছরের পুরনো গভীর জঙ্গল পুড়ছে। আগুন শুধু পৃথিবীর ফুসফুস ধ্বংস করছে না। সাড়ে তিনশোরও বেশি আদিবাসী গোষ্ঠী, যারা শহরের কোলাহল থেকে দূরে ঘন জঙ্গলে বাস করে, তাদের আবাসকেও ধ্বংস করছে। মনে পড়ছে ইকুয়েডরের আদিবাসী কিচুয়া গোষ্ঠীর সেই পরিবারগুলির কথা, যাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল আমাজন ঘুরতে গিয়ে।
আমার মা কিছু দিন আগে লাতিন আমেরিকার ছোট দেশ ইকুয়েডরের রাজধানী কিতোতে আসেন। কিতো আমার কর্মক্ষেত্র। আমরা গেলাম আমাজন ঘুরতে। কিতো থেকে আমাজন জঙ্গলে ঢুকলাম ন্যাপো প্রদেশের রাজধানী তেনা দিয়ে। তেনা হল ইকুয়েডরের ‘দারচিনি রাজধানী’। আমাদের গাইড কিচুয়া সম্প্রদায়ের এফ্রাইং। জঙ্গলের গা ঘেঁষে তার বাড়ি। রহস্যেঘেরা অরণ্যে ঢোকার আগে এফ্রায়িং মস্ত দা (স্প্যানিশ ভাষায় ‘মাচেতে’) নিল সঙ্গে।
জঙ্গলে ঘোরাতে ঘোরাতে বছর কুড়ির এফ্রাইং চেনাল নানা রকম ফল, সব্জি ও ওষুধের গাছ। গাছ থেকে ‘কাকাও’ ফল পেড়ে খাওয়াল, যা থেকে চকোলেট তৈরি হয়। ওদের মেয়েরা উৎসবে যে ফলের লাল রঙে মুখ সাজায়, সেই ফল ভেঙে দেখাল। ওদের খাবার, ওষুধ, মেক-আপের রং সব জোগান দেয় আমাজন। এফ্রাইং গর্ব করে বলল, ‘আমরা ভাত, পাস্তা খাই না। যা আমাজনের জঙ্গলে পাওয়া যায় তাই আমাদের খাবার। জঙ্গলেই আছে সব রোগের ওষুধ। জঙ্গলের উপরেই আমাদের জীবন নির্ভর করে।’ সূর্য ডুবল, টর্চের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম বিভিন্ন জীবজন্তু আর সাপের গল্প। প্রাচীন জঙ্গলের কাহিনি বইয়ে পড়ে যে উৎকণ্ঠা তৈরি হত, তা অনুভব করলাম বাস্তবে। গামবুট-পরা পা আটকে যাচ্ছে কাদায়। ডালপালা পথ রোধ করছে। ভয় হচ্ছে, যদি কোনও জন্তু আক্রমণ করে? এফ্রাইং অভয় দিল, ‘হিংস্র জন্তুরা সাধারণত জঙ্গলের আরও গভীরে থাকে।’
পরের দিন ন্যাপো নদীর বুকে ‘ক্যানো’ করে ভ্রমণ। ন্যাপো আমাজনের নবম বৃহত্তম উপনদী। অপরিসীম তার সৌন্দর্য। গাইডের সঙ্গে নামলাম একটি দ্বীপে। কিচুয়া বাড়িতে তৈরি পানীয় ‘চিচা’ খেলাম। নরম মিষ্টি আলুর মতো ইউকা পচিয়ে এই ‘চিচা’ তৈরি করেন তাঁরা। আরও অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের কথা শুনলাম তাঁদের কাছে, যাঁরা লড়াই করছেন আমাজন জঙ্গলের চোরাচালানকারী, তেল খননকারী ও দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। লাতিন আমেরিকার একটি সংবাদ সংস্থায় কাজ করার সুবাদে আমাজন নিয়ে তাঁদের আবেগ প্রত্যক্ষ করলাম। আমাজনের ভূমিকে আমাজনবাসীরা পবিত্র বলে মানেন। আমাজনের সম্পদে তাঁদের জীবন কাটে, তাই আমাজন-জঙ্গল রক্ষার দায়িত্বে তাঁরা সরব। এ দিকে বড় কোম্পানিগুলোর নজর এখন তাঁদের এই সম্পদের ওপর।
মার্কিন তেল সংস্থা শেভরন ইকুয়েডরের আমাজন অঞ্চল থেকে তেল উত্তোলন করে, বিষাক্ত বর্জ্য জঙ্গলে ফেলে যায়। সে ঘটনা খবরের শিরোনাম হয়েছিল। পাঁচটি আমাজনিয়ান জনজাতি শেভরনের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে একটি মামলা দায়ের করেছিল। ২০১৮ সালে এই মামলাটিতে তারা হেরে যায়। আদ্রিয়ানো কন্ত্রেরাস এবং ইভান কাস্তেনেইরা নামে দুই সাংবাদিক ‘আ ক্যানসার ইন আমাজন’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। বর্জিত পদার্থের জন্য মানুষ কী ভাবে ক্যানসারে ভুগছে, জল ও জমি কতটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তা এই তথ্যচিত্রে আছে।
তবে ২০১৯ সালে ওয়াওরানি নামে আর একটি উপজাতি ইকুয়েডর সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে জিতেছে। কেননা সরকার আর একটি সংস্থাকেও আমাজনের জমিতে তেল খননের অনুমতি দিয়েছিল। কেবল ইকুয়েডরের আমাজনেই নয়, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের আমাজন অঞ্চলেও এ জাতীয় ঘটনা চলছে। যেমন ব্রাজিল। বৃষ্টির স্বল্পতা আমাজনে আগুন লাগার একটি কারণ হলেও, এই বিপর্যয়ের জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর বাণিজ্যবান্ধব নীতিকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। তাঁদের অভিযোগ, ব্রাজিল সরকার জঙ্গলরক্ষায় বিশ্বাস করে না। সরকারি উৎসাহে অবৈধ গবাদি পশুপালন, চাষ এবং কৃষি ব্যবসা ফুলেফেঁপে বাড়ছে। বহু আদিবাসী নেতা খুন হয়েছেন আমাজন আক্রমণকারীদের হাতে। গবাদি পশু পালনের জন্য আগুন জ্বালিয়ে নাকি বনকে সরিয়ে ফেলা দরকার। আর তার জন্যই পৃথিবীর ফুসফুস পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। তুমুল সমালোচনার মুখে বেসরকারি অনুদান সংস্থাগুলোর দিকে পাল্টা অভিযোগ করছেন ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট।
ফেব্রুয়ারির এক শীতের বিকেলে কিচুয়া বাড়িতে বসে শুনেছি ওঁদের লড়াইয়ের কথা। ‘মানুষের জীবন কি এত সস্তা? বন পুড়লে, সম্পদ লুট হলে আমরা বাঁচব কী ভাবে?’ আজ যখন আমাজন অরণ্য পোড়ার খবর লিখি বা পড়ি, তখন মানুষের ভবিষ্যৎ পরিণতির আশঙ্কাতেই মন ছেয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy