Advertisement
E-Paper

পথ হাঁটছি পথের দিকে না তাকিয়ে

চেনা ছকে বয়ে যাচ্ছে উত্তরের নাগরিক জীবন। কিন্তু নদী-পাহাড়-অরণ্যের হাতছানি কিংবা পথের দু’পাশের দোকান, বাজার, গাছগাছালি সত্যিই কি তেমন প্রভাব ফেলছে আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায়? লিখছেন অনিন্দিতা গুপ্ত রায় এই সবই আসলে বোধ হয় একটা বহমানতার দিকে, জীবনযাপনের গড়িয়ে যাওয়ার দিকেই ছোট ছোট নুড়িপাথর। টপকে যাও বা হোঁচট  খেয়ে— তাদের আলো শরীরে কোথাও থাকবেই।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৯ ০১:১৬
Share
Save

কিছু কিছু অস্তিত্ব নেই হয়ে না যাওয়া অবধি এমন স্বতঃসিদ্ধ অভ্যেস হয়ে ওঠে যে, তাকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে, থামতে, হাঁটতে, দাঁড়াতে একটা আরামের অনুভূতি হয়। যাকে বলা হয় ‘কমফর্ট জোন’। তারা কখনও সজীব, কখনও জড়বস্তু, কখনও-বা পায়ে পায়ে চলতে চলতে নিছক কিছু অবস্থা বা অবস্থান। তাদের থাকায় কিছু মায়া থাকে, ছায়া থাকে, স্মৃতি থাকে, অনুরাগ থাকে, অভিমান থাকে। আবার কখনও বিরক্তিও থেকে যায়। আর থাকে অভ্যেসজনিত অনাদর।

ঘরের পাশে আরশিনগর

এই সবই আসলে বোধ হয় একটা বহমানতার দিকে, জীবনযাপনের গড়িয়ে যাওয়ার দিকেই ছোট ছোট নুড়িপাথর। টপকে যাও বা হোঁচট খেয়ে— তাদের আলো শরীরে কোথাও থাকবেই। আসা যাওয়ার পথের ধারে সব সময় চোখ মেলে খেয়ালই হয় না এ রকম কত কিছু থাকে। ধরা যাক, একটা ছোট্ট কলাবাগান, রাস্তার ধারে কিছুটা ধুলোপথ ছেড়ে ডোবার পাশ দিয়ে ঝুপসি হয়ে। তার পিছনেই আবার একটা শালুকপুকুর। দু’একটা মাছরাঙা প্রতিদিনের সকালে রোদ পোহাতে আসে। শহর ছেড়ে সামান্য বাসরাস্তার গড়ানো পথেই হেলে পড়া রোদ্দুরে বুড়ো জারুল বা চাঁপা গাছের পুরনো গেরস্থালি জড়িয়ে ওঠা বুনো লতাটি চোখেই পড়েনি কারও। নেহাত যানজটে আটকে পড়ে একঘেয়ে বিরক্তিকর আসা-যাওয়ায় কদাচিৎ কোনও দৃষ্টি ছুঁয়ে গিয়েছে তাকে। সে চাওয়ায় কোনও পরিচিতি বা পছন্দ জড়িয়ে থাকার কথা নয়।


আসা-যাওয়ার পথের ধারে

কয়েকঘর ছোট ছোট বসতবাড়ি, কাঁচা মেঝে, টিনের চাল, দরমার দেওয়াল। লতিয়ে ওঠা সামান্য লাউ-কুমড়ো-ঝিঙে ফুলে মোমাছির দু’বেলা গুনগুন। আছে তারা, থাকে তারা। মানুষজনের নিত্যনৈমিত্তিক চলনের দু’ধারে। সন্ধ্যা পার করে ফেরার পথে আবছায়া দোচালার ভিতর থেকে কচি গলায় সুর করে ইতিহাস পড়ার শব্দ কানে ভেসে কিছুক্ষণ আটকে থাকে। আমরা শুনি না এসব। কানে আসে যদিও। অভ্যেসের মধ্যেই থাকে। ঋতুবদলের হাজার ছোট ছোট উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাট হয়ে গড়াগড়ি খায় খুব কাছেই। মন তাকে আলগোছে টুকে রাখে অজান্তেই। কখন কাশ ফোটে, কখন মন্দার আর পলাশে চরাচর পাতা খসিয়ে আগুন হয়ে থাকে, কখন বুড়ো শিরীষের ডালপালায় পুরনো অর্কিড বেগুনি পাপড়িতে একাই সালঙ্কারা, কখন প্রবল ধুলোয় উড়ে আসা চাঁপাফুলের ছেঁড়া স্তবক, কখনই-বা কুয়াশায় তৈলচিত্রের নিপুণতায় সাদা-কালো ল্যান্ডস্কেপ আর থৈ থৈ সবুজে নৌকো পারাপার করতে করতে গ্রাম-শহর উপচিয়ে আচমকা কখন যেন স্থির হয়ে আসা জলে পদ্মকুঁড়ির উঁকিঝুঁকিতে ঢাকের আওয়াজ!

পাহাড়পুর পেরলেই চেনা গল্প

এ সবই পড়ে থাকে আমাদের চোখের সামনে, পিছনে, ভিতরে, বাইরে। আমরা ঠিকঠাক না দেখেও দেখিই আসলে, জানিও। এই তো চলে এল দোমহনির মোড়। বিরাট পাকুড় গাছটার নীচে বাসটা দাঁড়ালেই প্রাণ জুড়নো হাওয়াটা। তারপর ওই তো তিস্তা পার হয়ে গিয়েছি, আর কয়েক কিলোমিটার। ওই তো গ্যারেজ পেরিয়েই মোড়ের ধারের বেতের ফার্নিচারের দোকানগুলো। কত কত বছর ধরে নিপুণতায় সোফা, টেবিল, দোলনা, ল্যাম্প, ট্রে বা বুকসেলফ বানানো চলছে ছোট ছোট ঘরগুলোয়। আহ্, এই তো আর দশ মিনিটেই ঘর। পাহাড়পুর পেরোলেই অচেতনে একটা শ্বাস সমস্ত শহরমুখো যাত্রীর অন্দরেই হাওয়া দেয় ঝিরিঝিরি। এ সবই খুব চেনা গল্প, চেনা কথা। যদি এই সমস্ত চেনা বিষয়গুলো আচমকা একদিন একেক জনের কাছে না-থাকা হয়ে যায়, কী হয় তখন? এই নেই হয়ে যাওয়া আচমকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় একদিন যা ছিল, তার অনস্তিত্ব। একদিন যা ছিল অবহেলার দৃষ্টিপথে নিতান্ত অনাদরের অভ্যেস, তাকে হারিয়ে ভিতর অবধি হু হু করতে থাকে প্রিয়জন বিচ্ছেদের কষ্ট। যা আছে, তা দেখিনি। যা নেই, তাকেই হারিয়ে আজ দেখছি মনোশ্চক্ষে— এ বড়
বিষম ভার! নিতান্ত বেরসিক অন্যমনস্ক নাগরিকেরও স্মৃতিকাতরতায় হঠাৎ খেয়াল হয়, ফাল্গুন নয়, এখন আ-বৎসর
তীব্র ধুলোঝড়। রাস্তা সম্প্রসারণের মহাযজ্ঞে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে চেনা বাঁক, গাছ, পথের মোড়, শনিমন্দির, রিকশাস্ট্যান্ড, ছোট্ট চা-দোকান, ডোবা, বসতি— ধূ ধূ পথ জুড়ে শুধু সাদা ধূসর ধূলোর উড়ে আসা, যা বন্ধ কাচের ভিতরেও এক রকম শ্বাসরুদ্ধকর মৃত্যুবোধের জন্ম দেয়। আলজিভ অবধি বালিতে ভরে যায়। যেন পাকস্থলি ঝাড়লেও ওই শুকনো গুঁড়োগুলো বেরিয়ে হয়ে আসবে! সামান্য ঘোর লেগে গেলে চোখ খুলে বোঝা যায় না, কোন অঞ্চলে গাড়ি ঢুকল। সমসত্ত্ব বৈশিষ্ট্য পেয়ে যাচ্ছে প্রতিটি রাস্তা।

বন্ধু, কী খবর বল

এমনটাই তো হওয়ার ছিল। সকলের জন্য প্রসারিত বিস্তৃত রাস্তা, আরও অবাধ, মসৃণ হাইওয়ে ধরে আরও আরও দ্রুতগতিতে পৌঁছনোর দৌড়ে প্রথম হওয়ার স্বপ্নই দেখি তো আমরা। তবু কেন যেন খুব
অচেনার ভিড়ে নিঃসঙ্গ আর একঘেয়ে লাগে যাত্রাপথ। অজস্র মৃত কবন্ধ গাছের শরীর পেরিয়ে এঁকে বেঁকে উড়ালপুল আর হাইওয়ের নির্মাণশালার ভিড়ে চেনা সঙ্কেত হারিয়ে নিজেকেই আসলে হারিয়ে ফেলছি কি? মন আবার নিজের মতো করে তৈরি করে নেবে তার প্রিয় পথ-নির্দেশক, যেমনটি নেয় অচেনার পথে বারবার যেতে যেতে। কিন্তু তবু জানি, কিছু কিছু
উপড়ানো শিকড়ের ক্ষত নিরাময়হীন হয়। হারানো গাছটির বিস্তৃত শিকড় যে বুকের ভিতর দিয়ে অনেকটা আসলে!


(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

North Bengal Nature

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।