সংস্কৃত ভাষায় একটা কথা আছে, ঘরে যখন আগুন লাগিয়াছে তখন কূপ খুঁড়িতে যাওয়ার আয়োজন বৃথা”, লিখছেন এক শতক আগের স্বদেশি আন্দোলনের ব্যর্থতায় বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ রবীন্দ্রনাথ। “বঙ্গ বিচ্ছেদের দিনে হঠাৎ যখন মুসলমানকে আমাদের দলে টানিবার প্রয়োজন হইল, তখন আমরা সেই কূপ খননেরও চেষ্টা করি নাই— আমরা মনে করিয়াছিলাম, মাটির উপরে ঘটি ঠুকিলেই জল আপনি উঠিবে। জল যখন উঠিল না, কেবল ধুলাই উড়িল তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমাপরিসীমা রহিল না। আজ পর্যন্ত সেই কূপ খননের কথা ভুলিয়া আছি। আরো বার বার মাটিতে ঘটি ঠুকিতে হইবে, সেইসঙ্গে সে ঘটি আপনার কপালে ঠুকিব।’’
এ বার ভোটের ফল বেরোনো ইস্তক বিশ্লেষণ ও দোষারোপের শেষ নেই। কার ভোট কত শতাংশ কমল, বামে আর রামে ক’টা ফুটকির তফাত, ইত্যাদি। সবই ঠিক, কিন্তু নিজেদের ক্ষতবিক্ষত মুখের সামনে আয়না না ধরলে পরিসংখ্যানে আর কী যায় আসে। আমরা, বাঙালি ভদ্রলোকেরা, নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বাকি মানুষদের কতটা মূল্য দিতে পেরেছি? “যদি নিজেদের হৃদয়ের দিকে তাকাই, তবে এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, ভারতবর্ষকে আমরা ভদ্রলোকের ভারতবর্ষ বলিয়াই জানি”, সেই একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের খেদ, লোকসাধারণকে ‘‘সর্বপ্রকারে অপমানিত করা আমাদের চিরদিনের অভ্যাস।’’ আজ যদি পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-উত্তরবঙ্গের মানুষ আমাদের রাজনীতির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, কী করে দোষ দেব তাঁদের?
আমরা অনেক বলেছি, হিন্দুত্ব গোবলয়ের সংস্কৃতি, ওরা মনীষীদের মূর্তি ভাঙে, মসজিদ ভাঙে, কেমন আনকালচার্ড গোছের, বাংলার সংস্কৃতি অমন নয়। বলতে বলতে নিজেদের ভেতর দিকে তাকাতে ভুলে গিয়েছি। এড়িয়েছি বাস্তব সত্য— গত একশো বছরে সোনার বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হয়েছে, অবিশ্বাস বেড়েছে। বলেছি, পুলিশের সাহস আছে, হেলমেট ছাড়া গেলে ‘ওদের’ ধরবে? ‘ওরা’ রাস্তা বন্ধ করে নমাজ পড়ে! গরু কাটে! একই অন্ধকার অন্য দিকেও। মতুয়ারা এসসি এসটি সব সুবিধে নিয়ে নেয়! তথ্য-পরিসংখ্যান দেখিনি। জানতে চাইনি, বাংলার মুসলমান ও নমঃশূদ্র কী ভাবে থাকে, হেলমেট পরে কি না, কী ভাবে বারংবার একই রাজনৈতিক খেলার বলি হয়।
তাই, প্রশ্নটা যত না দলীয় রাজনীতির, তার চেয়ে বেশি আমাদের সামাজিক ব্যর্থতার। অভিযোগ, ফোন-ইন্টারনেটে ভুয়ো খবর-ছবি-ভিডিয়ো ছড়াচ্ছে। কিন্তু আসল কথা, সেগুলো ছড়ালে আমরা কতটুকু কী করেছি। খুব বেশি হলে বলেছি, আরে ওটা তো ভুয়ো, নালিশ করো। অথচ প্রশ্ন করিনি, কেন সকলে চটপট মিথ্যেগুলো বিশ্বাস করছে? কেন আমাদের বাবা-কাকারা সেগুলো অন্যদের পাঠিয়ে চলেছেন? আজকে আমাদের পরিবারের নামে কুৎসিত কথা এলে নিশ্চয় এক দেখায় বিশ্বাস করতুম না? কিন্তু ভুয়ো খবর বিশ্বাস করছি কারণ পাশের মানুষদের আমরা চিনি না, মুখ ফিরিয়ে থাকি, শুধু মনে শান্তি পেতে তোষণ, সংঘর্ষ, হেলমেট ইত্যাদি কপচাই। আমরা মার্ক্স-ফুকো নিয়ে বড় বড় কথা বলি, গান-নাচ-থিয়েটার করে সংস্কৃতি করি, ঘরে ফিরেই হাসতে হাসতে বলি, ইস, সব পাকিস্তানের এজেন্ট! মাকড়দহ-খিদিরপুর বাসকে বলি, নেড়েপাড়া টু নেড়েপাড়া। মুখোশ পরে, ভাবের ঘরে চুরি করে, আর যা-ই হোক, সামাজিক রাজনীতি হয় না।
একশো বছর ধরে বিভেদের চারা এই সমাজে বেড়েছে। উত্তর ভারত থেকে কেউ এসে আমাদের এ সব শেখায়নি। এই সামাজিক বিভাজন কোনও পার্টি করেনি, এ আমাদের নিজস্ব উত্তরাধিকার।
তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশে কেমন মাতৃভাষাভিত্তিক, অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতি হয়, বাংলায় কেন হয় না? এ প্রশ্নের উত্তর তো এই গভীর সামাজিক বিভেদ, এবং ‘ছোটলোক’দের প্রতি আমাদের অবজ্ঞার মধ্যেই। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড়ীয় আন্দোলন সেখানকার অন্ত্যজদের একশো বছরের বিদ্রোহ। পেরিয়ার-আন্নাদুরাইয়ের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণদের চাপ সরিয়ে তারা সমাজবন্ধন দৃঢ় করেছে। ভাষা সেখানে সকলের সমান অধিকারের প্রতীক। তাই হিন্দি চাপানোয় তাদের আপত্তি। কেরলের বামপন্থী রাজনীতিও তাদের নিচু জাতের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত। সামাজিক বিভেদ না জোড়া গেলে, ভাষা দিয়ে কিছু যায় আসে না। তৃণমূল মাঝেমধ্যে বাঙালি আবেগ জাগানোর চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু তাতে সামাজিক বাঁধন শক্ত হয় না, উল্টে মৌলবি-পুরোহিত-গুন্ডাদের প্রকাশ্য সমর্থনে ক্ষোভ বাড়ে।
এই আমরা, যারা হতাশ হতে হতে এখনও বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতি চাই, আমাদের প্রথমে নিজেদের সামাজিক ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। ভোটের অঙ্ক দিয়ে এর তলে পৌঁছনো যাবে না। এই সামাজিক মেরুকরণ আমাদের মন থেকে আগে তাড়াতে হবে। ছোট ছোট ধাপ— অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘরে ডেকে এনে খাওয়াই, ঘর-বাড়ি ভাড়া দিই, টাকা ধার দিই, চাকরির সন্ধান পেলে জানাই। এতেই অনেক অন্ধকার দূর হবে। ঘটি ঠোকা থামিয়ে একটু একটু করে কূপ খনন করা যাবে।
অনিকেত দে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ও তথাগত দত্ত টাফট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy