Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

মানবাধিকার দিবস: পালনের চেয়েও জরুরি অধিকার জানা

মানবাধিকার দিবস পালনের থেকেও বড় কথা মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইনি পথেই পথ চলা। সেই অধিকার রক্ষার মানবিক ভাবনাটা জারি রাখাও মানব-অধিকার। লিখছেন মহিউদ্দীন আহমেদ।এক জন মানুষের বেঁচে থাকা এবং সমাজে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানবাধিকার অপরিহার্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, (এই) মানবাধিকার কার জন্য? কে দেবে এই অধিকার?  মানবাধিকার কথাটির তাৎপর্যই বা কী? এ সবের উত্তর আজও আমরা অনেকে জানি না। বুঝি না। 

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:১৮
Share: Save:

বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালিত হল ১০ ডিসেম্বর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কমিশন, আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ, মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠন, ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা— সকলে নিজের নিজের মতো করে আলোচনাসভা, মানব বন্ধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পদযাত্রা, পথ নাটকের আয়োজন করছে। ১৯৪৮ সাল থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ থেকে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর দিনটিকে মানবাধিকার দিবস পালন করার কথা বলা হয়। সেই মতো পালনও হয়।
মানবাধিকার মানে মানুষের অধিকার। এক জন মানুষের বেঁচে থাকা এবং সমাজে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানবাধিকার অপরিহার্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, (এই) মানবাধিকার কার জন্য? কে দেবে এই অধিকার? মানবাধিকার কথাটির তাৎপর্যই বা কী? এ সবের উত্তর আজও আমরা অনেকে জানি না। বুঝি না।

মানবাধিকার নিয়ে বিভিন্ন দেশে সরকারি ভাবে কমিশনও গঠিত হয়েছে। কোথাও মানুষের অধিকার খর্ব হল কিনা, কেউ নির্যাতিত বা নিপীড়িত হল কিনা— এ সব দেখা ও প্রতিকারের জন্যই তৈরি হয়েছে মানবাধিকার কমিশন। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে আমাদের দেশ অনেকটা এগিয়েছে। সকলের হাতে হাতে দামি স্মার্টফোন। বাড়িতে কম্পিউটার। সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় দেশের তরুণ থেকে বয়স্কেরা। অথচ এই ফেসবুক, টুইটারের যুগেও দেশবাসীর বড় অংশই জানল না, মানবাধিকার ‘খায় না গায়ে মাখে’। আমরা জানলাম না, মানবাধিকার কোথায় পাব আর কে দেবে। সাধারণ গরিব মানুষ, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, অত্যাচারিত মানুষ, জাতিগত হিংস্রতার শিকার যাঁরা, ভূমিকম্প, ব্যাপক দুর্বিপাক বা দুর্যোগের শিকার, শিল্পক্ষেত্রে বিপর্যয়ের শিকার, মানুষ নিয়ে অবৈধ কারবারের শিকার কিংবা সংবিধানের ৩১(১) ধারায় বর্ণিত বেকার, মানসিক অসুস্থ, শারীরিক প্রতিবন্ধী, সংশোধনাগার বা হেফাজতে থাকা পুরুষ-মহিলা, শিশু— এরা সকলেই এই অধিকারের আওতায়। ন্যায় বিচারের জন্য বিনা খরচে আইনি সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

কিন্তু, স্রেফ শিক্ষা, প্রচার ও সচেতনতার অভাবে এখনও আমরা এ সব সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। স্বয়ং এক বিচারককে ঘরোয়া আলোচনায় একাধিক বার আফশোস করতে শুনেছি, ‘কত বছর কেটে গেল, কত মানুষ টাকার অভাবে হয়তো ন্যায়বিচার পায়নি।’ অথচ বাস্তব হল, সাধারণ গরিব মানুষ, যাঁদের বার্ষিক আয় ১ লাখ টাকার কম, তাঁরা মহকুমা, জেলা জজকোর্ট বা হাইকোর্টে নিখরচায় মামলা করার সুযোগ পাবেন।

সুপ্রিম কোর্টে মামলার ক্ষেত্রে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার কম আয় হলেই বিনা খরচে মামলা করার সুযোগ পাবেন তাঁরা। শিশু ও মহিলাদের যতই আয় হোক না কেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আয়ের কোনও প্রমাণ লাগবে না। এমন সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ জানেনই না তাঁদের এই অধিকারের কথা। আজ সারা বিশ্বের অসংখ্যা মানুষ অস্থির ভাবে বেঁচে রয়েছেন। নিজের দেশ থেকে হয় তাঁদেরই সরকার তাঁদের খেদিয়ে দিচ্ছে, নয়তো হিংস্র ক্ষমতাশালী কোনও গোষ্ঠীর হিংসার শিকার হয়ে নিজের জন্মভূমি থেকেই পালাতে হচ্ছে। নতুবা বন্দি থাকতে হচ্ছে। সাধারণ স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকা, চলাফেরা করাটাও দায় হয়ে পড়ছে বিশ্বের নানা দেশে।

আমাদের দেশের উদাহরণই ধরা যাক। কোনও সভ্য সমাজ বা দেশেই কালাকানুন (ব্ল্যাক ‘ল’) থাকাটা কাম্য নয়। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই মানবিক ও সকলের অধিকার নিশ্চিত করবে, এমন আইন প্রণয়ন করাটা জরুরি। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের দেশে এমন নানা আইন আছে, যার সুযোগ নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে উত্তরোত্তর। শুধু তাই নয়, এ দেশে জন্ম নিয়েও নিজের পরিচয়পত্র জোগাড় করতে আজ হিমশিম খেতে হচ্ছে কত মানুষকে। সাধারণ মানুষ রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, জন্ম সার্টিফিকেট পেতে দিনরাত হন্যে হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে প্রশাসনের দরজায় দরজায়। রাত থেকে লম্বা লাইন পড়ছে ডাকঘর, ব্যাঙ্কের সামনে। সেই লাইনে যুবক-যুবতী থেকে বয়স্ক, শিশু কোলে মহিলা কে নেই! কাজকর্ম ফেলে, নাওয়াখাওয়া ভুলে দিনরাত তাঁরা ধর্না দিচ্ছেন নাগরিকত্ব প্রমাণের মরিয়া চেষ্টায়। এই আশঙ্কা থেকে যে, পাছে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘অ-নাগরিক’ তকমা না সেঁটে যায়! কেউ নিজের চেনাজানা লোক ধরে ‘ম্যানেজ’ করে নিলেও অধিকাংশই চরম হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। অথচ নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র পাওয়া তাঁদের অধিকার।
সম্প্রতি হায়দরাবাদে এক তরুণী নৃশংস ভাবে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পরে পুড়িয়ে মারা হয় তাঁকে। এই ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। ওই ঘটনাকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যে ভাবে হইচই ফেলেছি, মোমবাতি মিছিল, মৌন মিছিল শুরু করেছি বা পুলিশের এনকাউন্টারে ‘ধর্ষক’কে (তদন্ত, বিচার না করেই) গুলি করে মেরে ফেলার পরে উল্লাসে আনন্দে মেতে উঠছি। অথচ আমাদেরই পাশের বাড়ির যে মেয়েটি স্বশুরবাড়িতে নিত্য নির্যাতিত, যে বাবা তাঁর মেয়ের বিয়ের পণের টাকা জোগাড় করতে পারছেন না বলে বিয়ে দিতে পারছে না, যে গরিব ঘরের মেয়েটি দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড়ের জন্য পাথর খাদান, কয়লা খাদানে দিনরাত কাজ করে দূষণে জর্জরিত হয়ে অকালেই কঠিন রোগে মারা যাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পায়নি, যে বৃদ্ধ বাবা সন্তানের হাতে মার খেয়ে বাড়িছাড়া হচ্ছেন—তাঁদের প্রতি আমাদের নজর নেই। তাঁদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে আমরা পারছি না বিনা খরচায় মামলা করার জায়গা থাকতেও, সেখানে নিপীড়তদের পৌছে দিতে। না পারছি সেই সুযোগের কথাটা তাঁদের কানে পৌঁছে দিতে। ফলে, আমাদের চারপাশে রোজ কোনও না কোনও ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে গেলেও তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। কিংবা আমরা চোখ বুজে রাখছি।
আজ কোনও সরকারি অফিস- হাসপাতাল-পুরসভায় নিজের প্রয়োজনে গেলে সেখানে দামি প্যান্ট জামা পরা তথাকথিত ভদ্রলোক সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের কাছে যে ব্যাবহারটা পান, এক জন খেতমজুর, গরিব দিনমজুর ময়লা লুঙ্গি, জামা পরে গেলে সেটা পান না।

অথচ আমরা কেউ প্রশ্ন তুলি না যে, সংবিধানে সব মানুষের সমানাধিকারের কথা বলে আছে, তা কেন মান্যতা পাচ্ছে না? এক জন মানুষ তার নিজের পরিবারে বাবা, মা, ভাই, বোনেদের কাছ থেকে জমি জায়গার অংশ পেতে যতটা সজাগ, তার থেকেও তাঁর বেশি সজাগ থাকা দরকার ছিল রাষ্ট্রের কাছে, স্থানীয় প্রশাসনের কাছেও তাঁর ন্যায্য অধিকার বুঝে নেওয়ার বিষয়ে। পরিবারের সম্পত্তির হিসেব না পেলে যেমন আদালতের শরণাপন্ন হই আমরা, তেমনই তোমার রাষ্ট্র, তোমার সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন যদি নাগরিককে তাঁর অধিকার পাইয়ে দিতে সচেষ্ট না হয়, সেখানেও তিনি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন।
জাতীয়, রাজ্য বা জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণ করতে পারেন ন্যায় অধিকারের জন্য। মানবাধিকার দিবসে আমাদের কর্তব্য এই তথ্যগুলো আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। স্রেফ দিনটিকে পালন করা নয়।
মানবাধিকার দিবস পালনের থেকেও বড় কথা মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইনি পথেই পথ চলা। সেই অধিকার রক্ষার মানবিক ভাবনাটা জারি রাখাও মানব-অধিকার। তাই আলোচনা-র‌্যালি-বক্তৃতা-পথসভার মাধ্যমে ঘটা করে মানবাধিকার দিবস পালনের চেয়েও জরুরি আশপাশের মানুষজনকে তাঁদের প্রাপ্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা।

লেখক জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের আইনি সহায়ক, মতামত নিজস্ব

অন্য বিষয়গুলি:

Human rights
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy