তপন সিংহের গল্প হলেও সত্যি। এক বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মকর্তা রূপে অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত পেনসিল হাতে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বিজ্ঞাপন এবং তার ছবি ঠিক কী ভাবে পাঠক দর্শকের মনে শক দেবে। ঠিক কতখানি শক থেরাপি দরকার উপভোক্তার মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করতে হলে? একটি টাই-এর বিজ্ঞাপনীয় চিত্র কতটা নারী-দেহ উন্মোচিত রাখবে। আর্টের বিবিধার্থ ব্যবহার কতটা মারাত্মক হতে পারে! দেশ, কাল, সময় ইত্যাদির পট পরিবর্তন হয়েছে। হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মানুষ তাঁর স্বভাব আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বললেই চলে। বিজ্ঞাপনে শুধুমাত্রই প্রডাক্ট-এর বিক্রিবাটা হয়, তা নয়। বিজ্ঞাপনে নির্বাচন প্রার্থী থেকে রাজনৈতিক ফিলজ়ফি এবং অরাজনৈতিক দর্শনসুলভ প্রজ্ঞা— সবই বিক্রিবাটা হয়।
গণমাধ্যম অর্থে বহু কাল শুধুই মুদ্রিত পত্রিকা বোঝানো হয় না। মিডিয়া, গণমাধ্যম, পাবলিক ফোরাম, প্ল্যাটফর্ম যা-ই বলি না কেন, তা সরাসরি সমাজমাধ্যমকেই মনে করায়। ফেসবুকের নিউজ় ফিড-এর আড়ালে যে দর্শনের দামামা বাজায়, তা বিজ্ঞাপন ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আর কিছুই নয়। দূরদর্শন, তা সরকারি হোক বা বেসরকারি, তার চেয়ে বহু যোজন এগিয়ে সমাজমাধ্যম। সমাজমাধ্যমের প্রসারিণী চলনের মন্ত্র মোহে আবিষ্ট হয়ে আসে এই পৃথিবীর শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ সবাই। বিভিন্ন সংগঠিত বা অসংগঠিত পোস্ট এককথায় নিয়ন্ত্রণ করে, সাধারণ মানুষ পরের মুহূর্ত থেকে কী নিয়ে চিন্তা করবে। এবং এই জটিল পরীক্ষার মিথ্যে গহ্বরেই জন্ম হয় এক মারণ ডিজিটাল ভাইরাস— ‘ফেক নিউজ়’!
ফেক নিউজ় বা মিথ্যা সংবাদ অতি সাধারণ ঘটনার মধ্যে একটি। সংবাদমাধ্যমে অনিচ্ছাকৃত ভাবে যদি কোনও ভুল সংবাদ ছেপে বেরোয়, তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা একটা সংস্কার ও সভ্যতা। এই প্রথা আগে ছিল, এখনও আছে। কিন্তু সমাজমাধ্যমের ডিজিটাল দেওয়ালে যে মিথ্যা সংবাদের চেহারা সামনে আসে, তা এক আদিম অসভ্যতা। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে অসাধু ব্যবসাদার, সাধুসন্ত থেকে শুরু করে যে কোনও মানুষ সামান্যতম দায়িত্ব বহন না করেই ব্যবহার করে চলেছেন এই দেওয়ালের ডিজিটাল ইট। দু’বছর-চার বছর বা অধিক পূর্বের ছবিকে ভেঙেচুরে নিজেদের মতো ব্যবহার করা তো বাঁ হাতের কনিষ্ঠার কাজ! নীচে নামতে নামতে আর কতই বা নীচে নামা যায়, হয়তো ঈশ্বরই জানবেন একমাত্র।
মরক্কোর আলোকসজ্জিত দেশীয় সীমান্তের ছবিকে নিজেদের বলে ব্যবহার করা থেকে শুরু করে, অন্য কোনও দেশের মসজিদে ধর্মোন্মাদের আস্ফালনকে নিজেদের দেশের ঘটনা বলে চালানো, কিংবা বিহার নির্বাচনের ফলাফল আসার পর মাটির গর্তে মিষ্টি ফেলার ছবি ব্যবহার— এ সবই এখনকার সময়ের ফেক নিউজ়ের কারসাজি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফেক নিউজ়ের কাণ্ডকারখানা মানুষের মগজধোলাই বা শক দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত। কিন্তু এ কোন দিকে চলেছি আমরা, সভ্যরা?
সমাজমাধ্যম আমাদের কোভিড ভুলিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে মন দিতে বলছে। সমাজমাধ্যম আমাদের জিডিপি ছেড়ে পাকিস্তানে মন দিতে বলছে। সমাজমাধ্যমই দ্রব্যমূল্যের প্রবল বৃদ্ধি উপেক্ষা করে আমাদের পুরো মনোযোগ দিতে বলছে অন্য কোনও বিষয়ে। বস্তুত, শুধু সমাজমাধ্যমকে দোষারোপ করারও কিছু নেই। এ মানুষের দায়িত্ব, সে কী ভাবে, কী প্রকারে সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করবে এবং অন্যকে প্রভাবিত করবে।
মাতৃপ্রেম, দেশপ্রেম বা যে কোনও অনুভূতিজাত আবেগের বিপণিকেন্দ্র সমাজমাধ্যম। এক কালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য যে ডিজিটাল পরিসর তৈরি করা হয়েছিল, তা আজকাল আমেরিকা থেকে ভারত, সর্বত্র নির্বাচনে নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। ‘প্রোপাগান্ডা’ শব্দটা আজকাল সাপের মতোই বিষধর। তথ্য যাচাই এখন এক অলীক স্বপ্নবৎ, যার প্রত্যাশা করা অনুচিত।
পুরনো ছবিকে পুনরায় ভিন্ন কোনও ঘটনায় ব্যবহার করে যে স্বার্থান্ধ অসভ্যতা চলছে, তার শেষ কোথায়? যখন অভুক্ত অসহায় কৃষক আন্দোলনরত মানুষজনকে তুমুল অসম্মানিত করা হয়, যখন ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের চিত্র ব্যবহার করা হয়, তখন কী মনে হওয়া উচিত! এ ছাড়াও স্থানীয় বা দেশীয় স্তরের নির্বাচনে বিখ্যাত সমাজমাধ্যমটির ব্যবহার যে যুদ্ধের মতোই ভয়ঙ্করী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গণপ্রহারের মতো ঘটনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ঘটনায় এই মাধ্যমটির অবিমৃশ্যকারিতা সর্বজনবিদিত।
অবিলম্বে সমাজমাধ্যমের রাশ সরকারি নজরদারির আওতায় আনা উচিত। কিন্তু বাঘের ঘরে ঘোগের বাসায়, ঘোগটিকে বার করে আনাও জরুরি। না হলে ভিতরে ভিতরে যে মিথ্যের শক্তি বেড়ে উঠছে তার প্রোপাগান্ডার ডালপালা নিয়ে, তা এক সমূহ বিপদের আশঙ্কাবাহী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy