কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নহে। রবিবার সন্ধ্যায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গৈরিক গুন্ডাবাহিনী যে তাণ্ডব চালাইল, এবং যে ভাবে তাহাকে চলিতে দেওয়া হইল, সভ্য সমাজে তাহা কল্পনারও অতীত। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে অবশ্য এই আক্রমণ ক্রমশ জলভাত হইতেছে। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালাইয়াছিল পুলিশ, অথবা পুলিশের পোশাকে দলীয় বাহুবলীরা। জেএনইউ-তে যাহারা মুখ ঢাকিয়া লৌহদণ্ড হাতে ক্যাম্পাসে ঢুকিল, মহিলাদের হস্টেলে ঢুকিয়া যথেচ্ছ অত্যাচার করিল, ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে মারধর করিল— অভিযোগ, তাহারা সঙ্ঘপোষিত গুন্ডা। এই সময় হঠাৎ কেন জেএনইউ-কে আক্রমণ করিতে হইল, সে বিষয়ে বিবিধ অনুমান সম্ভব। কেহ বলিতে পারেন, শাহিনবাগের প্রতিবাদ হইতে নজর সরাইবার তাগিদ তীব্র হইয়াছিল। পরিস্থিতির চাপে গৈরিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে ভুল হইয়া যাইতেছে, এবং রবিবারের ঘটনাক্রম তেমন ভুলেরই উদাহরণ— এই কথাও কেহ বলিতে পারেন। কারণ যাহাই হউক, এমন আক্রমণ যে হইতে পারে, ইহাই চরম লজ্জার। শাসকের যদি ইতিহাসবোধ থাকিত, যদি নৈতিকতা সম্বন্ধে সচেতনতা থাকিত, যদি সুশাসন সম্বন্ধে সামান্য ধারণা থাকিত, তবে রবিবারের ঘটনায় তাঁহাদের মাথা হেঁট হইয়া যাইত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গুন্ডারা তাণ্ডব করিয়াছে, তাহা যতই নিন্দার্হ হউক না কেন, তাহাতে কেন্দ্রীয় সরকারের, বা নেতৃত্বের, দায় কোথায়? দায় একটি নহে, একাধিক। এই গুন্ডাদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চিত যে অনুমানগুলি দিল্লির হাওয়ায় ভাসিতেছে, তাহাকে যদি গুরুত্ব না-ও দেওয়া হয়, এই কথাটি অস্বীকার করিবার উপায়মাত্র নাই যে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। পুলিশ তাহাদের অধীন। যে পুলিশ রাতের অন্ধকারে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় ঢুকিতে তিলমাত্র দ্বিধা করে নাই, সেই পুলিশই রবিবার জেএনইউ-এর সদর দরজার বাহিরে নিষ্ক্রিয় দাঁড়াইয়া ছিল— ‘বিনা অনুমতি’তে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাহারা প্রবেশ করিবে কোন অধিকারে! রক্তাক্ত ছাত্রছাত্রী, আতঙ্কিত চিৎকার, কিছুই তাহাদের সক্রিয় করিতে পারে নাই। তাহাদের নির্নিমেষ চক্ষুর সম্মুখেই তাণ্ডব চলিল। অন্য দিকে, জেএনইউ-এর উপাচার্যের সরকারপ্রীতি গত কয়েক বৎসরে কিংবদন্তিপ্রায় হইয়াছে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তারক্ষা তাঁহার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তিনি নড়িয়া বসিতে যতখানি সময় লইলেন, তত ক্ষণে গুন্ডাবাহিনীর উদ্দেশ্য পূরণ হইয়া গিয়াছে। এই উপাচার্যের দায়িত্বও কি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এড়াইতে পারে? সর্বোপরি, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব হইতে পাড়ার কর্মকর্তা, সকল স্তর হইতে জেএনইউ সম্বন্ধে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হইয়াছে, যে ভঙ্গিতে তাঁহারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের প্রবল শত্রু হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, এই আক্রমণের পিছনে সেই বিষের প্রভাব অনস্বীকার্য। সেই দায় কাহার?
গুন্ডাদের লক্ষ্য ছিল ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু ছাত্র সংসদের সভাপতি ঐশী ঘোষের পাশাপাশি একই ভাবে আহত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুচরিতা সেন। শুধু তিনিই নহেন, আরও অনেক শিক্ষক আহত। বর্বররা শিক্ষকদের রেয়াত করিবে, এমন আশা কাহারও নাই, কিন্তু শিক্ষকদের আক্রান্ত হইবার কারণ, তাঁহারা আক্রান্ত ছাত্রদের রক্ষা করিতে ছুটিয়া আসিয়াছিলেন। সব শিক্ষক নহেন, কিন্তু বহু শিক্ষক। না আসিলেও তাঁহাদের চাকুরিতে সমস্যা হইত না, কেহ তাঁহাদের দায়ী করিত না। কিন্তু, ছাত্রকে আক্রান্ত হইতে দেখিলে শিক্ষক ঢালের ন্যায় তাঁহাদের আড়াল করিবেন, ইহাকেই ধর্ম বলে। শিক্ষকের ধর্ম। শিক্ষার ধর্ম। উপাচার্য শিখিতে পারেন। শিখিবার বয়স নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy