Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Baluchari Sari

বালুচরীতে স্বপ্ন বুনতেন দুবরাজ, হেমচন্দ্র

মানুষের চেহারা, ঠাকুর দেবতার মূর্তি, ঠাকুরবাড়ি, মসজিদ, নামাবলি, বিভিন্ন রকম টেবিলক্লথ, স্কার্ফ, রুমাল কিছুই অসাধ্য ছিল না। তিনি কখনও শাড়ির পাড়ে নিজের নাম বুনে দিতেন। লিখছেন গৌতম সরকার নানা সূত্রে জানা যায়, জিয়াগঞ্জের পূর্বনাম ছিল ‘বালুচর’।

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:১৮
Share: Save:

তখন ১৬১২ সাল। যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যকে দমন করতে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গির প্রেরিত সেনাপতি মানসিংহ যখন গৌড়ে আসেন, কিছু দিন ‘বালুচর’ গ্রামে অবস্থান করেন। বালুচরের সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করে। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ভবানন্দ রায় মজুমদার। তাঁকে স্থানটির নাম জিজ্ঞাসা করেন। ভবানন্দ বলেন, ‘‘মহারাজ এ স্থানের নাম বালুচর। গঙ্গার তীরেতে গ্রাম পত্তন হ‌ইয়াছে।’’ মানসিংহ তা শুনে বলেন, ‘‘অপূর্ব স্থান। এই স্থানে রাজধানী হইলে উত্তম হয়।’’ এই কথোপকথনের পর স্থির করলেন, কিঞ্চিৎকাল সেখানে বিশ্রাম করবেন।

নানা সূত্রে জানা যায়, জিয়াগঞ্জের পূর্বনাম ছিল ‘বালুচর’। এই বালুচরে বসেই বয়ন-শিল্পীরা শাড়ির সুন্দর জমির উপর কোণে ও আঁচলায় বিচিত্র নকশার কাজে অলঙ্কারের অভিনবত্বে, বয়ন নৈপুণ্যের উজ্জ্বলতায় কলা রসিকদের প্রীতি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা রেশম ব্যবসার জন্য তাঁদের দুই প্রতিনিধি হিউজেস ও পার্কারকে পাঠিয়েছিলেন মুখসুদাবাদ মাসুমাবাজার (তখন‌ও মুর্শিদাবাদ নামকরণ হয়নি) ও সৈদাবাদে। ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে কাশিমবাজার‌ অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বলে দেয়, বালুচরে ওই সময় থেকেই রেশম শিল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। বয়নশিল্পীদের মধ্যেও চলেছিল নিভৃত সাধনা। ‘বালুচরে’ তৈরি শাড়ির‌ই নাম ‘বালুচরী’। ঢাকার মসলিনের মতো জিয়াগঞ্জের বালুচরী শাড়ি ছিল বয়ন শিল্পসৌন্দর্যের এক বিস্ময়কর নিদর্শন। বালুচর সন্নিহিত মীরপুর, বাহাদুরপুর, দেবীপুর, সাধকবাগ, আমডহর, বেলেপুকুর, রণসাগর, আমাইপাড়া প্রভৃতি গ্রামগুলিও ছিল তখন বয়নের কাজে নিয়োজিত।

তবে এই শিল্পে নিবেদিত প্রাণ অসংখ্য শিল্পীদের নাম জানা না গেলেও উনবিংশ শতাব্দীতে বালুচরের অন্তর্গত বাহাদুরপুরের দুবরাজ দাস (জন্ম: আনুমানিক ১৮১৩ সাল) ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের নাম বালুচরী শাড়ির সঙ্গে অমর হয়ে আছে। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দুবরাজ দাস প্রথমে বাস করতেন জিয়াগঞ্জ থেকে মাইল তিনেক দূরে মিরপুর গ্রামে। প্রথম জীবনে তিনি চামড়ার ঢোল, ডুবকি, চটপটি প্রভৃতি তৈরি করে মেলায় মেলায় ঘুরে বিক্রি করতেন। হঠাৎ একদিন মেলাতে এসে কবিগান শুনে তাঁর কবি হ‌ওয়ার ইচ্ছে হয়। তাঁর স্মৃতি শক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই সেটা মনের মধ্যে গেঁথে যেত। শোনা যায়, তিনি লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। কবির দল‌ও গড়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিকে তিনি বালুচরে এলে এক মুসলমান শিল্পীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এই শিল্পী বালুচরী বিভিন্ন রকম জিনিস বোনার কাজে পারদর্শী ছিলেন। দুবরাজ অত্যন্ত মনোযোগ ও দক্ষতার সঙ্গে ওই শিল্পীর শিল্পকর্মে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর সকল কাজ দেখে নিজের অসামান্য প্রতিভা বলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তা শিখে নেন।

বাহাদুরপুরে অবস্থান কালে তিনি জাদুকরের মতো ‘বালুচরী’ শাড়ি বুনতেন। মানুষের চেহারা, ঠাকুর দেবতার মূর্তি, ঠাকুরবাড়ি, মসজিদ, নামাবলি, বিভিন্ন রকম টেবিলক্লথ, স্কার্ফ, রুমাল তাঁর কিছুই অসাধ্য ছিল না। তিনি কখনও কখনও রুমালে বা শাড়ির পাড়ে নিজের নাম বুনে দিতেন।

১৮৯২-৯৩ সালে দুুুুবরাজের বয়স যখন প্রায় ৮০ বছর। তখন বাহাদুরপুর গ্রামে যে ছ’খানা তাঁত চালু ছিল তার সবকটি‌‌‌রই মালিক ছিলেন তিনি। তবু তিনি ছিলেন দরিদ্র। উপযুক্ত ক্রেতা নেই, কাদের জন্য বালুচরী বুনবেন দুবরাজ? মাসে ৩০-৪০ টাকা বেতন পেলেই তিনি তাঁতিদের জন্য তাঁত তৈরি করতে ও সংস্কার করার পদ্ধতির শিক্ষাদানে রাজি ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেই এহেন অসীম গুণবান শিল্পীকে জীবদ্দশায় কোনও সম্মাননা ব্যতিরেকেই মরতে হয়।

দুবরাজ শিষ্য হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য বালুচরী শাড়ীর শুধু এক অসাধারণ শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র ভারতের এক অদ্বিতীয় বয়নশিল্পী। নতুন নতুন রূপভাবনায় বয়নশিল্পের চরম উৎকর্ষে পৌঁঁছে গিয়েছিলেন তিনি, যা গুরু দুবরাজকেও ছাড়িয়ে যায়। বয়ন পদ্ধতিতে অপরূপ রূপকলার পরিস্ফূটনে প্রস্তুত রেশমের শাল, টেবিল ক্লথ, রুমাল প্রভৃতি উনিশ শতকের প্রথম দশকে অনুষ্ঠিত প্যারিস এবং বিদেশের প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত করা হয়। প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিল্পকলা প্রদর্শনীতে তাঁঁর তৈরি শিল্পকর্মের বস্ত্রসম্ভার সমাগত সকলের‌ই বিস্ময় সৃষ্টি করে এবং স্বর্ণপদক লাভ করে। আবার ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে নিযুক্ত জেলাশাসক অশোক মিত্রের উদ্যোগে এবং জেলা সিল্ক অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের সহযোগিতায় টেক্সটাইল কলেজে ২৫০ টাকা বেতনে হেমচন্দ্র কিছু দিন শিক্ষকতাও করেন।

বাহাদুরপুরে বোনা বালুুুুচরী শাড়িই ১৯০০ সালে প্যারিসে এবং ১৯১১ সালে লন্ডনে বিশ্বমেলায় সুুুবর্ণপদক লাভ করে। এ কাজটি সম্ভব হয়েছিল বহরমপুরের সিল্ক ব্যবসায়ী সুধাংশুশেখর বাগচীর অনুপ্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি অর্থলগ্নি করে বিশ্বের দরবারে দুুুবরাজ-হেমচন্দ্রের অপূর্ব সৃৃষ্টিকে তুুলে ধরেছিলেন। ফলস্বরূপ প্রথম বাঙালি হিসেবে ‘সার্টিফিকেট অফ অনার’ এবং ‘সুুুুবর্ণপদক’ লাভ করেন। কিন্তু পদক প্রাপ্তির খবর শিল্পীর কর্ণগোচর হয়নি। তাই তো বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে—‘‘জমিতে যাদের ঠেকে না চরণ / জমির মালিক তাহারাই হন।’’ বালুুুচরী শাড়ি বিদেশ থেকে স্বর্ণপদক এনে দিলেও স্রষ্টার দিনকাটে নিদারুণ অর্থকষ্টে। হেমচন্দ্রের এই করুণ পরিণতির কথা তুলে ‘পরিক্রমা’ সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সম্পাদক উমানাথ সিংহ তাঁর সম্পাদকীয় স্তম্ভে জোরালো অভিযোগ জানালে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের নজরে আসে। বিধানচন্দ্রের উদ্যোগে শিল্পী হেমচন্দ্রকে ভরতপুরের এক অনুষ্ঠানে ২০০০ টাকা অনুদান ও উত্তরীয়সহ সম্মানিত করা হয়। এই অনুষ্ঠানে হেমচন্দ্র গুরু দুুুুবরাজ-সহ সাধকবাগের মহান্ত মহারাজ রামদাস আউলিয়া, সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ এবং শিবেন্দ্র নারায়ণ মৈত্রের সাহায্যের কথা উল্লেখ করেন। ১৯৫৯ সালে নিঃসন্তান হেমচন্দ্রের মৃত্যু হয়। কারও কারও মতে, হেমচন্দ্রের হাত ধরেই এই শিল্পের একটি যুগের শেষ হয়।

ঋণ স্বীকার: (১) বালুচরী রূপকথা, উমানাথ সিংহ, মুর্শিদাবাদ চর্চা, প্রতিভারঞ্জন মৈত্র। (২) কারমাইকেল রুমাল ও বালুচরী, বিশ্বেন্দু বাগচী, ঝড় ২৮ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২০১৩। (৩) মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়। (৪) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (৩য় খণ্ড), বিনয় ঘোষ। (৫) রেশম শিল্পের..বিস্ময়কর বালুুুচরী, রমাপ্রসাদ ভাস্কর, অনুভব পত্রিকা, শারদ ২০১৫ কৃতজ্ঞতা : অংশুমান রায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Baluchari Sari History Weavers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy