হকারির সামান্য জমির উপর দাঁড়িয়েছিলাম এত দিন, লকডাউনের পর গোড়ালি তুলে আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কত ক্ষণ ব্যালে ডান্সারদের মতো দাঁড়িয়ে থাকা যায়, বলুন তো?” বালিগঞ্জ হকার্স ইউনিয়নের সম্পাদক রয়্যাল সাহা চিন্তিত। তাঁর দোকানে পাঁচ জন কর্মী কাজ করেন। দৈনিক আড়াইশো টাকা মজুরির কর্মীরা গত দু’মাসে মুদির দোকানে ছয়-সাত হাজার টাকা ধার করে ফেলেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার রাস্তার হকারদের দশ হাজার টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, শুনেও ভরসা পাচ্ছেন না। তাঁর আশঙ্কা, যদি বা ঋণ মেলে, পরিবারের খাইখরচা মেটাতে সে টাকা ব্যয় করে ফেলবেন হকাররা, তার পর সুদের টাকা গুনবেন।
ব্যাঙ্ক ঋণে হকাররা কতটা আগ্রহী হবেন, সে প্রশ্নও থাকে। ব্যাঙ্ককে এড়িয়েই তাঁদের লেনদেন চলে। প্রথমত, স্বল্প পুঁজির ব্যবসা— আনাজ, মাছ, বা ঝালমুড়ি-চপের দোকান শুরু করতে দু’তিন হাজার টাকার সংস্থান থাকলেই হয়। সেই পুঁজি পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা অন্য হকারের থেকেই ধার পাওয়া যায়। মাঝারি ও বড় হকাররা, যাঁরা কাপড়, ব্যাগ, ইলেকট্রনিক্স, ঘর সাজানোর জিনিস, উপহার সামগ্রী ইত্যাদির কারবারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা মহাজনের থেকে মাল নিয়ে আসেন। বিক্রি হলে টাকা মিটিয়ে দেন। এখানে মহাজন কিন্তু সুদখোর মহাজন নয়, বড়বাজার থেকে পাইকারি হারে মাল-কেনা ব্যবসায়ী, অথবা ছোট কারখানার মালিক, যাঁরা নিজের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে হকারদের কাছে হাজির হন। হকারদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অবস্থাও শোচনীয়।
হকারদের মূলধনী পুঁজি মহাজনের সঙ্গে বিনিময়ের মাধ্যমে আবর্তিত হয়। এই পুঁজির ভাণ্ডটি যখের ধনের মতো আগলে রাখতেন হকাররা— সংসার খরচ, বিয়ে-শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠান-চিকিৎসায় ওই আমানতে হাত ঠেকাতেন না তাঁরা। প্রয়োজনে হকাররা টাকা ধার করেন কাবুলিওয়ালার কাছে। সুদের হার চড়া, হাজার টাকায় দুই মাসে ১২৬০ টাকা দিতে হয়। উৎসবের সময়, চৈত্র সেলের সময় বেশি মাল তোলার তাগিদে কাবুলিওয়ালার থেকে ঋণ নেওয়াটা খুবই প্রচলিত। ব্যাঙ্ক থেকে এই রকম খাপছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়া মুশকিল। তবে আরও বড় সমস্যা হল অবৈধতার। ২০১৪ সালে ‘পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইন’ পাশ হয়। তার আগে দীর্ঘ দিন হকারদের কেবলমাত্র অপরিচ্ছন্ন, ফুটপাত-জবরদখলকারী বলে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। পেশা হিসাবে স্বীকৃতি পেতেই স্বাধীনতার পর সত্তর বছর লেগে গিয়েছে। ফুটপাত দখল করে এ ভাবে ব্যবসা চালাতে দিলে তা নাগরিকের অধিকারের পরিপন্থী কি না, সেই তর্ক অবশ্যই আছে, কিন্তু আপাতত তাতে ঢুকব না। শুধু মনে করিয়ে দেব, রাষ্ট্র এই পেশাকে স্বীকার করতে সময় নিয়েছে দীর্ঘ দিন।
খাতায়-কলমে হকারি পেশা হিসেবে গণ্য হলেও, হকাররা প্রায় কেউই বৈধ ব্যবসায়ী বলে স্বীকৃত হননি। তাঁদের ট্রেড লাইসেন্সও নেই। অবৈধ পেশার মানুষ কী করে ঋণ পাবেন? অথচ ব্যবসার অঙ্ক কিন্তু কম নয়। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, গোলপার্কে প্রায় আড়াই হাজার হকার আছেন। দৈনিক গড় বিকিকিনি সাত হাজার টাকা ধরলে এই এলাকাতেই বছরে লেনদেন হয় ৬৫০ কোটি টাকার। ভারতের প্রায় এক কোটি মানুষ এই পেশায় যুক্ত, কলকাতায় প্রায় তিন লক্ষ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয়দের আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। হকাররা জীবনের শুরু থেকে আত্মনির্ভর, সরকার-পুলিশ-পুরসভার ক্রমাগত চোখ রাঙানি, উচ্ছেদের হুমকি ঠেকিয়ে, ‘হপ্তা’র বন্দোবস্ত করে টিকে আছেন। অন্যের ওপর নির্ভরতার প্রশ্নই ওঠে না। আধুনিক শহরের অপরিহার্য অংশ হলেন এই হকাররা। পথ বিক্রেতা (‘স্ট্রিট ভেন্ডারস’) আইনে বলা হয়েছে, শহরের আড়াই শতাংশ জনসংখ্যা হকারিতে থাকবেই, এই হিসাব ধরে শহর পরিকল্পনা করতে হবে। হকার সংগ্রাম কমিটির নেতা শক্তিমান ঘোষের ধারণা, লকডাউনের পরে বেকারত্ব বাড়ার ফলে হকারির পেশায় আসার প্রবণতাও বাড়বে।
এত হকারের পুঁজির প্রয়োজন মিটবে কেমন করে? অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের ঋণ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা (২০১৫) বা পশ্চিমবঙ্গের ‘স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান’ প্রকল্প রয়েছে। কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক সংস্থা নয়, এমন ক্ষুদ্র ব্যবসাকে ঋণ দিতে পারে এই প্রকল্পগুলি। তবে শক্তিমানবাবুর মতে, সর্বাধিক দশ শতাংশ হকার হয়তো এই সব প্রকল্পে আবেদন জানিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে হকারদের প্রয়োজন অনুদান। জাতীয় হকার ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শ্রম মন্ত্রকের কাছে হকারদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। এবং ছোট উৎপাদনী সংস্থাগুলিকে (যাদের অন্যতম ক্রেতা হকাররা) মুদ্রা যোজনার মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়ার দাবি করা হয়েছে।
এমনিতেই শপিং মল ও অনলাইন রিটেলের সঙ্গে দাম কমানোর প্রতিযোগিতায় হকাররা নাজেহাল ছিলেন। শক্তিমানবাবুদের হিসাবে, গত বছর পাঁচেকে ব্যবসা কুড়ি শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। আজ হকাররা সমাধানের রাস্তা বার করার চেষ্টা করছেন। ‘হকারবাজার ডট কম’ নামে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, সমবায়ের মাধ্যমে লড়াইয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। এই অসম প্রতিযোগিতায় তাঁরা সফল হবেন কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy