Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
লাগাম চাই হিংসার বার্তায়
Hate speech

বাক্‌স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যা চলছে, তার নাম রাজনীতি

এই বিশাল প্রসার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায় যে, এই ডিজিটাল মঞ্চের মাধ্যমে  ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষপূর্ণ বার্তা।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২০ ০০:২৬
Share: Save:

ফেসবুকের বয়স মাত্র সাড়ে ষোলো বছর। কিন্তু বিশ্বে তার বিপুল বিস্তার। ভারতে ওই সংস্থার তিনটি ডিজিটাল সমাজমাধ্যম মঞ্চ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে— ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপ। ৪০ কোটি ভারতীয় হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছেন, ফেসবুক ব্যবহার করছেন প্রায় ৩৫ কোটি।

এই বিশাল প্রসার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায় যে, এই ডিজিটাল মঞ্চের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষপূর্ণ বার্তা। বিশেষত গত কয়েক বছরে ভারতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লাগাতার যে সব উস্কানিমূলক বার্তা প্রচার হচ্ছে, তার পিছনে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের ভূমিকা কতখানি, সে প্রশ্ন বার বার উঠছে। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, দিল্লির দাঙ্গার আগে ফেসবুক ইচ্ছে করে বিজেপির সাম্প্রদায়িক হিংসামূলক বার্তায় রাশ টানেনি। মার্কিন দৈনিক ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, ফেসবুক পোস্টের উপর নজরদারির ভারপ্রাপ্ত কর্মীরা খুন-অগ্নিকাণ্ডের হুমকি দেওয়া একটি পোস্ট সরাতে চেয়েছিলেন। ওই পোস্ট করেছিলেন এক বিজেপি নেতা। তা সরাতে বাধা দেন ফেসবুকের ভারতীয় কর্মকর্তা। বলেছিলেন, তাতে ফেসবুকের ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

ফেসবুকে বিদ্বেষ-বার্তার প্রচার, এবং তার ফলে প্রাণহানি, সম্পত্তিনাশের অভিযোগ এই প্রথম নয়। এ কথাগুলো ফেসবুকের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার একটা দৃষ্টান্ত মিলেছে মায়ানমারে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ-বার্তা ক্রমাগত ছড়িয়ে গিয়েছে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত বেশ কিছু পেজ এবং অ্যাকাউন্ট। এই অবাধ বিষোদ্গারের শেষ অধ্যায়ও বিশ্ব দেখেছে— রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের হত্যা, উদ্বাস্তুর ঢল। ফেসবুক যে হিংসাত্মক পেজগুলো বন্ধ করেনি, তা ২০১৮ সালের এক রিপোর্টে বলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি স্বতন্ত্র তথ্য অনুসন্ধানকারী মিশন।

২০১৯ সালে নিউজ়িল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দু’টি মসজিদের বাইরে এক ব্যক্তি গুলি করে মেরে ফেলেছিল ৫১ জনকে, আহত হয়েছিলেন আরও ৪৮ জন। ভয়ানক সেই হত্যাকাণ্ড আগাগোড়া সে দেখিয়েছিল ফেসবুক লাইভ-এ। সারা বিশ্বে নিন্দার মুখে পড়ে ফেসবুক কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে লাইভ ব্যবহারে। তার আগেই অবশ্য ভারত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সম্প্রচার দেখেছে সমাজমাধ্যমে। ২০১৭ সালে রাজস্থানের বাসিন্দা শম্ভুলাল রেগার মালদহের বাঙালি মজুর আফরাজুল খানকে কী ভাবে নির্যাতন করে পুড়িয়ে মেরেছিল ‘লাভ জিহাদ’-এর অজুহাতে, তার ভিডিয়ো ছড়িয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপে।

এ নিয়ে প্রশ্ন করলে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের কর্তারা উত্তর দেন, ‘এন্ড টু এন্ড ইন্স্ক্রিপশন’ কাজ করছে, তাই কে ভিডিয়ো তৈরি করছে, কে বিতরণ করছে, কাকে বিতরণ করছে, সংস্থার কর্তারা জানেন না, কিছু করতেও পারেন না।

প্রশ্ন উঠবে, অন্যরা পারলে ফেসবুকই বা পারবে না কেন? উস্কানিমূলক বার্তা দেওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বার্তা আড়াল করেছিল টুইটার। এ বছর ২৯ মে যখন পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, পুরোদমে চলছে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন, তখন ট্রাম্প টুইট করেন, “হোয়েন দ্য লুটিং স্টার্টস, দ্য শুটিং স্টার্টস”— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে কথাটি বহু দশক ধরে বর্ণবিদ্বেষের সঙ্গে যুক্ত। টুইটার সংস্থা দু’ঘণ্টা পরে ঘোষণা করে, হিংসাকে প্রার্থনীয় বলে দেখানোর জন্য এই পোস্টটি টুইটার সংস্থার বিধিভঙ্গ করেছে। তাই টুইটার এই মন্তব্যটিকে বাতিল (ব্লক) না করলেও, আড়াল (হাইড) করছে।

ফেসবুক কিন্তু ট্রাম্পের বার্তা ব্লক বা হাইড করল না, রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মার্কিন কর্মীদের ক্ষুব্ধ আপত্তির মুখেও অবিচল ছিলেন জ়াকারবার্গ। ভারতেও দেখা গেল, উস্কানিমূলক পোস্ট রেখে দেওয়ার বিরুদ্ধে কর্মীরা আপত্তি জানালেও ফেসবুকের শীর্ষকর্তা তা সমাজমাধ্যম থেকে সরাতে দিলেন না। হত্যা করা, উপাসনার স্থান পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি রয়েই গেল ফেসবুকে। এটা উদ্বেগজনক, কারণ হিংসাত্মক বার্তা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতে নির্দিষ্ট আইন আছে। ফেসবুকের মতো সংস্থাগুলো ভারতে ব্যবসা করছে, অথচ ভারতীয় নিয়মকানুন মানছে না। দিল্লির দাঙ্গাই একমাত্র ঘটনা নয়। গত চার বছরে ভারতে অন্তত ৩০টি ঘটনায় মানুষকে গণপ্রহারে হত্যা করা হয়েছে, প্রতিটির পিছনে বিদ্বেষমূলক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ রয়েছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গা, সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর দাঙ্গা, দুটোর পিছনেই হোয়াটসঅ্যাপ-বার্তার ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ।

ফেসবুকের আসল চেহারাটা কী, তা নিয়ে তাই ভাবার সময় এসেছে। আমরা দেখছি, নানা দেশে মিথ্যে খবর বিতরণের একটা অস্ত্র হয়ে উঠছে ফেসবুক। বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় দক্ষিণপন্থী সরকার ও রাজনৈতিক দলের নেতারা ফেসবুক ব্যবহারে অধিক স্বচ্ছন্দ। বিজেপি দাবি করে, তারা সমাজমাধ্যম ভাল ব্যবহার করতে দক্ষ, তাই কংগ্রেস প্রভৃতি বিরোধীরা হিংসে থেকে তাদের আক্রমণ করে। এই ‘ভাল ব্যবহার’ কেমন, তার আভাস মিলেছিল ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, যখন রাজস্থানের কোটায় বিজেপির দলীয় সভায় অমিত শাহ খোলাখুলি বলেছিলেন, “আমরা যে কোনও বার্তাকে ভাইরাল করতে পারি, সত্যি বা মিথ্যে, টক বা মিষ্টি।” সে সময়ে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির দু’টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মোট সদস্য ছিল ৩২ লক্ষ (পরে গ্রুপের সদস্য সংখ্যায় রাশ টানে হোয়াটসঅ্যাপ)। ওই সভায় অমিত শাহ প্রায় রসিকতার ঢঙে জানান, অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কী ভাবে বিজেপির এক সদস্য একটি ভুয়ো হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ছড়িয়েছিলেন যে, অখিলেশ চড় মেরেছেন মুলায়মকে, যদিও বাস্তবে তখন অখিলেশ আর মুলায়ম ছিলেন ৬০০ কিলোমিটার দূরত্বে। তার পর স্নেহশীল অভিভাবকের মতো বলেন, “আমি জানি তোমরা এমন করতে পারো, কিন্তু কোরো না।”

আজ যখন ফেসবুকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন, আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক বার্তা বন্ধ করার দাবি করা হয়, ফেসবুক সব সময়ে বাক্স্বাধীনতার এবং ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকারের যুক্তি খাড়া করে। কিন্তু গবেষণা এটাই দেখাচ্ছে যে, ফেসবুক একটি নিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র মঞ্চ নয়। বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ মঞ্চ দু’টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, রাজনীতির ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য। সেই প্রক্রিয়ায় কত প্রাণ হারাচ্ছে, কত সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে, কত ক্ষতি হচ্ছে ভারতের, তার হিসেব করার সময় এসেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Hate speech Facebook Social Media
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy