বঙ্গের পূজাকমিটিগুলির নিকট যেন ইচ্ছাপূরণদেবী রূপে আবির্ভূতা হইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নগদ অনুদান, বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি, পুরসভা-পঞ্চায়েত কর মকুব— না চাহিতেই পূজার আয়োজকদের প্রাপ্তির ঝুলি উপচিয়া পড়িল। সংবাদে প্রকাশ, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনিয়া সভায় বিপুল হর্ষধ্বনি উঠিয়াছে। কিন্তু সভাগৃহের বাইরের নীরবতা মুখ্যমন্ত্রী শুনিয়াছেন কি? অতিমারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের জোড়া বিপর্যয় রাজ্যের কী হাল করিয়াছে, মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নহে। কর্মহীন, অন্নহীন মানুষ কোভিডে মৃত্যুর ঝুঁকি লইয়া ফের কাজের আশায় ভিন্রাজ্যে পাড়ি দিতেছেন। শিশু স্কুল ছাড়িয়া শ্রমিক হইতেছে, নাবালিকা বিবাহের ছলে বিক্রয় হইতেছে। চাষি জলের দরে ফসল বেচিতেছেন, শ্রমিক জলের দরে শ্রম বেচিতেছেন, দরিদ্ররা মহাজনি ঋণে নিমজ্জমান। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, স্কুলের মিড-ডে মিল এখনও শুরু হয় নাই, প্রান্তিক গ্রামগুলিতে বহু নারী ও শিশুর এক বেলাও পুষ্টিকর আহার জুটিতেছে না। আমপানে ধ্বস্ত বহু মানুষ আজও নিরাশ্রয়। রাজকোষের দৈন্যে বেতন-পেনশন অনিয়মিত হইবার আশঙ্কা দেখা দিয়াছে। এই সময়ে পূজার আয়োজকদের রাজকোষ হইতে ১৮৫ কোটি টাকার অনুদান দিবার সিদ্ধান্ত নৈতিক, না কি কেবলই রাজনৈতিক, সেই প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য। সরকারের নিকট বহু স্বার্থগোষ্ঠী, বহু বিপন্নের বিবিধ দাবি ও প্রত্যাশা থাকে। সরকার কাহাকে অগ্রাধিকার দিল, তাহার দ্বারাই সরকারের পরিচয় নির্ধারিত হয়। এই দুঃসময়ে উৎসবে আর্থিক সহায়তা সরকারের কী পরিচয় দিতেছে? পূজায় খরচ হইলে বিভিন্ন ভাবে সেই টাকা সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাইবে, অর্থনীতির উপকার হইবে— এই যুক্তি অর্থহীন। টাকা যদি দিতেই হয়, অভাবী মানুষের হাতে সরাসরি তুলিয়া দিবার বিভিন্ন পথ আছে, তাহার সুফল আরও অনেক বেশি, সুযোগসন্ধানীর পকেটস্থ হইবার আশঙ্কা অনেক কম।
পূজাতে সরকারি সহায়তা লইয়া নীতিগত আপত্তি বরাবরই রহিয়াছে। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় উৎসবের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কাম্য নহে। কিন্তু এই বৎসর সরকারের উৎসাহ দানের সিদ্ধান্ত আরও একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়িয়াছে— জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা। প্যান্ডেলের প্রবেশদ্বার যতই বড় করা হউক, অভ্যন্তরে দূরত্ব রাখিবার যে কৌশলই নির্ধারিত হউক, সংক্রমণের আশঙ্কা থাকিবেই। বিশেষজ্ঞরাও বলিতেছেন, নিজের প্রতিরোধক্ষমতায় অতিরিক্ত বিশ্বাস এবং রোগের বিপদকে তুচ্ছ করিবার প্রবণতা এমনই ছড়াইয়াছে যে, কোভিড-সতর্কতার বিধি তুচ্ছ করিতেছেন বহু মানুষ। পূজার ভিড়ে তাঁহাদের নিয়ন্ত্রণ করিবে কে? উৎসবের মাসে স্বাস্থ্যবিধি শিথিল না করিতে নির্দেশ দিয়াছে কেন্দ্র। বেশ কিছু রাজ্যে সংক্রমণ এখনও ঊর্ধ্বমুখী। পশ্চিমবঙ্গেও রেখচিত্র নিম্নগামী হয় নাই। হইলেও নিশ্চিন্ত হইবার উপায় নাই, বহু দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসিয়াছে।
যে কারণে স্কুল-কলেজ, ট্রেন, বিমান ইত্যাদি দীর্ঘ দিন বন্ধ রহিল, পূজার জন্য কেন তাহা উপেক্ষিত হইবে! সরকার সর্বজনীন পূজা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করিবে, এমন প্রত্যাশাই বরং স্বাভাবিক ছিল।
নিন্দকে বলিতেছে, সিংহবাহিনী উপলক্ষমাত্র। তাঁহার পূজার ছলে ইহা বস্তুত ইভিএম-অধিষ্ঠাত্রী নির্বাচনদেবীর বোধন। ক্ষমতাসীন নেতারা প্রায়ই এমন জনমোহিনী নীতি লইয়া থাকেন। কিন্তু আপৎকালে সেই চিরাচরিত রীতি বর্জনীয়। মুখ্যমন্ত্রী কেবল দলনেত্রী নহেন, তিনি প্রশাসক। জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য জনস্বার্থকে উপেক্ষা করা চলে না। যে কাজ স্বাস্থ্যসঙ্কটকে আরও তীব্র করিতে পারে, তাহার সরকারি সহায়তা কখনওই সমর্থনযোগ্য নহে। কঠোর সিদ্ধান্ত লইবার জন্য নেতা বন্দিত হইয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত ভারতের রাজনীতিতে কম নাই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পথে হাঁটিবার সাহস দেখাইতে পারিতেন। রাজ্যবাসীর স্বার্থেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy