ঐতিহ্য: কোচবিহার রাজবাটি। ফাইল ছবি
ইতিহাস আর ঐতিহ্য জড়ানো জেলা কোচবিহার। ইতিহাসের সূত্র ধরে লোককথা, পুরাণ সবকিছু নিয়ে কোচবিহার তার ঐতিহ্যকে বহন করছে। সম্প্রতি কোচবিহারের ১৫৫টি স্থাপত্য এবং স্মারককে হেরিটেজের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, কোচবিহারের হেরিটেজ কার্যত চূড়ান্ত ভাবে অবহেলিতই।
বাংলা গদ্যের প্রথম নিদর্শনের সঙ্গে কোচবিহারের রাজার চিঠি জড়িত। সাহিত্যসংস্কৃতির চর্চা, নাট্যচর্চা, বৈষ্ণব ধর্মচর্চায় কোচবিহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মহারাজ নরনারায়ণের আমলে কোচবিহার পেয়েছিল বৈষ্ণব ধর্মগুরু শঙ্করদেবকে। পরবর্তী কালে মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণ, রানি বৃন্দেশ্বরীদেবী, মহারানি সুনীতিদেবী সারস্বতচর্চায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ও মহারানি সুনীতিদেবীকে কেন্দ্র করে উত্তর পূর্বাঞ্চলে নারী শিক্ষা ও আধুনিকতার প্রসার ঘটেছিল। ভারতের শিকার-মানচিত্রে কোচবিহারের রাজ পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯১৫ সালে রাজকুমার ভিক্টর নিতেন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোচবিহারের সাহিত্যসভা। কোচবিহার রাজাদের নিজস্ব গ্রন্থাগারে দেশবিদেশের মূল্যবান বইপত্র সংরক্ষিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার ছিলেন কোচবিহারের রাজপরিবারের প্রিন্স হিতেন্দ্র নারায়ণ। কোচবিহারের সর্বশেষ মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর ক্রিকেট, ফুটবল ও পোলো খেলায় দক্ষ ছিলেন। ভারতীয় পোলো দলের অধিনায়কত্বও করেছিলেন তিনি। রঞ্জি ট্রফিতেও বাংলা দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সক্রিয় ভূমিকা ছিল মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব গঠনে। ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কুমার গজেন্দ্র নারায়ণ। যাঁর স্ত্রী সাবিত্রীদেবী ছিলেন কেশব সেনের দ্বিতীয় কন্যা ও মহারানি সুনীতিদেবীর বোন। সাবিত্রীদেবীর লেখা বই ‘কুমার গজেন্দ্র নারায়ণ’ থেকে তৎকালীন কোচবিহারের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। রানি নিরুপমাদেবী সম্পাদনা করতেন ‘মাসিক পরিচারিকা’ পত্রিকা। তৎকালীন বহু বিশিষ্ট লেখক সেখানে নিয়মিত লিখতেন। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘থার্টি সেভেন ইয়ারস অব বিগ গেম শ্যুটিং ইন কোচবিহার, দ্য ডুয়ার্স অ্যান্ড অসম’ মূল্যবান এক দলিল। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, নগরীর পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসারে কোচবিহারের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। কোচবিহারে এসেছিলেন ব্রজেন শীল, নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও কোচবিহারের যোগাযোগ ছিল।
তাই ভাবতে অবাক লাগে যে, এত সব ঐতিহ্য বহন করে আসা কোচবিহারের বহু হেরিটেজ নষ্ট এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে আজ নুতন করে হেরিটেজ স্মারকের নাম ঘোষণা করা হয়! ভাবলে হাস্যকরই লাগে! চোখের সামনে কত কিছু মুছে যেতে দেখলাম গত ৩০ বছরে! রাজআমলের অনেক ঐতিহ্যবাহী বাড়ি বিলীন হয়ে গিয়ে সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে হাইরাইজ, বহুতল, আবাসন, শপিং মল! কোচবিহারের মহারাজাকে লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্তের ঐতিহাসিক চিঠিটিও উধাও হয়ে গেল সরকারি মহাফেজখানা থেকে! শহরের প্রচুর জলাশয় বুজিয়ে ফেলা হল! সাহিত্যসভায় জল পড়ে নষ্ট হতে বসা প্রাচীন পুঁথি সংরক্ষণের কোনও সরকারি প্রয়াস নেই! রাজ-আমলের কত স্মারক যে উধাও, তার হিলেব মেলে না!
ঐতিহ্য: কোচবিহারের সাবিত্রী লজ। ফাইল ছবি
১৯৪৬-’৪৭ সালে কোচবিহারের ধূলিয়ায় হয়েছিল ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ। সেই ইতিহাস নিয়ে রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু তা নিয়ে তেমন কোনও কাজ কোচবিহারে হল না! মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের ঐতিহাসিক বইটির পুনঃপ্রকাশ নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তাই নেই কারও! অথচ বইটি থেকে বিংশ শতকের শেষ দিকের উত্তরবঙ্গের স্থানিক ইতিহাস, বন ও বন্যপ্রাণ নিয়ে কত মূল্যবান তথ্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব।
কোচবিহারের শেষ মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়ক। নানা ধরনের টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক ওঠাপড়ার সেই সময়কাল নিয়ে কোচবিহারবাসী তেমন কিছু জানতেই পারলেন না! লোকসঙ্গীতসম্রাট আব্বাসউদ্দিন ছিলেন কোচবিহারেরই সন্তান। বলরামপুরে তাঁর বাস্তুভিটের আজও সংস্কার হল না! ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক খাঁ চোধুরী আমানতুল্লার বড়মরিচার কাছারিবাড়ি আজও অধিগ্রহণ করেনি সরকার!
তা হলে আজ হঠাৎ হেরিটেজ স্মারক ঘোষণা করে কী লাভ? দিনের পর দিন হেরিটেজগুলি তো হারিয়েই গেল তীব্র উদাসীনতায়! তবে, যা গিয়েছে, তা তো গিয়েইছে! তা নিয়ে ভেবেই-বা লাভ কী! রয়ে গিয়েছে যেটুকু, সেগুলির সংরক্ষণ নিয়েই চিন্তাভাবনা করা জরুরি এখন।
(লেখক প্রেমেরডাঙা দেওয়ান বর্মণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy