Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে গিরিশের সমালোচনা খুবই পছন্দ হয়েছিল

অভিনেতা গিরিশ কারনাডের সংযম ভীষণ টানতো। এত বড় শিল্পী কিন্তু সহজ জীবনে সাবলীল ছিলেন। লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায় প্রিয়জনের বিয়োগ সতত দুঃখের, তবু অমোঘ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। ভারতীয় থিয়েটারের আত্মীয় এবং আধুনিক নাট্যকলার প্রধানতম চিন্তক, নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ কারনাড আজ আর আমাদের মধ্যে নেই— এটা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।

নাগমণ্ডলম: গিরিশ কারনাডের লেখা নাটক। —ফাইল চিত্র।

নাগমণ্ডলম: গিরিশ কারনাডের লেখা নাটক। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৯ ০৫:০২
Share: Save:

আজ থেকে প্রায় বছর চল্লিশেক আগে ত্রিতীর্থে আমরা ‘তুঘলক’ মঞ্চস্থ করি। সব মিলিয়ে পাঁচ সাতটি শো হয়। নানা কারণে নাটকটির আর কোনও শো করা না গেলেও, বেশ কিছু দর্শকদের ভাল লেগেছিল। এই নাটকটি করতে গিয়ে আমি গিরিশ কারনাডের লেখা ‘তুঘলক’ নাটকটি খুব খুঁটিয়ে পড়ি, আর পড়েই মুগ্ধ হয়ে যাই এবং অন্য নাটকও দ্রুত পড়ে ফেলি। এই নাটকে আমি তুঘলকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। নাটকটি পড়ে আমার বারবারই মনে হয়েছিল তুঘলক চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে একটু পাফ্ট অ্যাক্টিং করা দরকার। আমি অভিনয়ের সময় দুঃসাহসিক ভাবে বেশ কিছু জায়গায় পাফ্ট অ্যাক্টিং করি এবং অনেক দর্শকই সেটার জন্য আমার প্রশংসা করেছিলেন। হঠাৎ কেন এই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার দরকার পড়ল ?

প্রিয়জনের বিয়োগ সতত দুঃখের, তবু অমোঘ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। ভারতীয় থিয়েটারের আত্মীয় এবং আধুনিক নাট্যকলার প্রধানতম চিন্তক, নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ কারনাড আজ আর আমাদের মধ্যে নেই— এটা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। এতো বড়ো মাপের একজন ভারতীয় নাট্য ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়া আমাদের কাছে তো বটেই এবং উত্তরকালের কাছেও অভাবনীয় ক্ষতি। আমরা যারা নাট্যকলার সঙ্গে আত্মীকভাবে জড়িত তাদের কাছে গিরিশ কারনাড একটা ঘরানা, একটা যুগও বলা যেতে পারে। আজ তিনি জীবন রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার কারণে যেন কারনাডীয় নাট্য-প্রকরণ-দর্শনের ইতি হল। যে দর্শন ছিল যুগপৎ সত্য ও প্রতিবাদের মুখোশ উন্মোচন এবং প্রকরণে ছিল মিথকে ভেঙে-গড়ে আধুনিক নাট্যাখ্যান—সেই ‘যযাতি’ থেকে ‘হয়বদন’-ই হোক কিংবা ‘রক্তকল্যাণ’ থেকে ‘নাগমণ্ডলম্’-ই হোক—এই মিথ পুরাণের ভাঙা গড়ায় আধুনিক নাট্য প্রকরণ নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

গিরিশ কারনাডের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আত্মীয়তা বা সখ্য কোনওটাই ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল শিল্পসৃষ্টির মানসভূমি-সঞ্জাত অ-প্রত্যক্ষ ও অ-মৌখিক সৃষ্টিশীল মেল বন্ধন। কেননা কারনাডের নাটক পড়লে বোঝা যায় যে তিনি কত বড়ো মাপের ‘রোডস্ স্কলার’ ছিলেন। বিদেশে গবেষণা করলেও নাট্যকলা নির্মাণ করার সময় নিজের দেশীয় শিকড়কে ভুলে যাননি। বরং গভীর অধ্যাবসায়, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে ভারতীয় মিথ পুরাণ এবং প্রচলিত লোককথার গভীরে গিয়ে বহুস্তরিক সন্ধান চালিয়েছিলেন। তা নাটকগুলি পড়লে বা দেখলেই স্পষ্ট হয়। যখন আমি ‘হয়বদন’ নাটকের অভিনয় দেখলাম, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! সত্যি কথা বলতে অভিনয়ের থেকে বিষয় ভাবনায় তাজ্জব বনে গেলাম। একটি প্রচলিত লোককথাকে কিভাবে কারনাড যুক্তি ও প্রজ্ঞা দিয়ে দেহ ও আত্মার (বা মেধার) আধুনিক বিমিশ্রণ করেছিলেন তা আজও আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

গিরিশ কারনাডকে আমার ভাল লাগার আর একটা কারণ অবশ্যই তাঁর স্পষ্টবাদিতা। অপ্রিয় সত্য বলতে তিনি কখনওই পিছুপা হতে না—সেটা শিল্প-সংস্কৃতিই হোক আর রাজনীতিই হোক। মন আর মুখ তাঁর একই ভাবনায় বাঁধা, সেখানে কোনও মুখোশ ছিল না। কেননা অন্তর থেকে তিনি মুখোশকে ঘৃণা করতেন। যাই হোক তাঁর একটি ভাবনার সঙ্গে আমি একমত। তিনি লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন—রবীন্দ্রনাথ আর যাই হোন না কেন নাটককার নন, নাটকটা তিনি লিখতে জানতেন না। কেন জানি না, আমারও রবীন্দ্রনাথের বহু নাটক নিয়ে ঘোর আপত্তি আছে। বিশেষ করে ‘বিসর্জন’ আমার কাছে সবচেয়ে দুর্বলতম নাটক মনে হয়েছে। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে আমি রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো ধরে ধরে সমালোচনা লিখতে শুরু করি। কোনও রকম সমালোচনা না পড়েই একজন নাট্য করিয়ে হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাটকের কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে, ফাঁক আছে সেই দিকগুলি লেখায় খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, একদিন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে আমার কাঁধের ঝোলাটি হারিয়ে যায়, যার ভিতরে ওই খাতাটিও ছিল। আজ পর্যন্ত তা আর ফিরে পাইনি, এমনকি আমিও পুনরায় লিখে উঠতে পারিনি।

অনেক বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় গিরিশ কারনাড লিখেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী কোনও নাটকই নয়। সেই নিয়ে বাঙালি বিদ্বৎসমাজ সেদিন তুমুল তর্ক-বিতর্ক জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গিরিশ কারনাডের যুক্তিগুলো আমি দরাজ হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলাম। ২০১১ কি ২০১২ সালে রক্তকরবী রাজবংশী কথ্যভাষায় অনুবাদ করি। বলা ভাল আমার যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বর্জন-সংযোজন ও সম্পাদনার ভিতর দিয়ে রক্তকরবী অনুবাদ করি এবং ত্রিতীর্থে মঞ্চস্থও করি। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নিয়ে আমারও বেশ কিছু আপত্তি ছিল, যেমন গাঁইতি দিয়ে তাল তাল সোনা তোলার ধারণা, যা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। কিংবা যক্ষপুরীর ভিতরে গরুর মড়ক লাগার যৌক্তিকতা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, এমনকি নাটকের শেষটা বড্ড তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে বলে মনে হয়। আবার নন্দিনীকে বাস্তব থেকে কিছুটা দূরের আইডিয়ালিস্টিক চরিত্র করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই ধরনের আরও অনেক আপত্তি আমার আছে।

সব কিছু বিতর্কের পরেও তার নাটক বাংলাতে নামি পরিচালক থেকে অভিনেতা মঞ্চস্থ করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন।

অবন্তী চক্রবর্তী নির্দেশিত ‘নাগমণ্ডলম্’ নাটকটি দেখে আমি প্রোডাকশনের থেকেও নাটকের বিষয় ভাবনায় অনেক বেশি বিস্মিত হয়েছি। তাঁর লেখার কলম এতো শক্তিশালী যে প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ হতেই হয়।আর একটি কথা না বললেই নয়, গিরিশ কারনাডের অভিনীত সিনেমা ও টেলি ফিল্মের সব কটাই আমি দেখেছি। খুব মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। অভিনেতা হিসেবে তাঁর সংযম এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ আমাকে ভীষণ টানতো। তিনি এত বড়ো মাপের একজন মানুষ এবং শিল্পী ছিলেন অথচ খুব সাধারণ জীবন যাপনে তিনি সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। যা এ প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়।

তাঁর এই পরিণত বয়সে চলে যাওয়া আমাদের কাছে যেন ভারতীয় নাট্যাকাশে নক্ষত্র পতন হল।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Girish Karnad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE