নিপাট বাঙালি। ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো ছোটখাটো চেহারা। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলার টান। হিন্দি বলা বিশেষ রপ্ত হয়নি দিল্লিতে পঞ্চাশ বছর রাজনীতি করেও। তবু আসমুদ্রহিমাচল তিনি সর্বজনমান্যতা আদায় করে নিয়েছিলেন। বহির্বিশ্বও সপ্রশংস কুর্নিশ জানিয়েছে তাঁর বোধ-বুদ্ধি-প্রজ্ঞাকে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন এমনই ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রয়াণে শুধু ইতিহাসের অবসান ঘটল না, বাঙালির গর্বের ভান্ডারেও গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হল।
জাতীয় জীবনের সবখানেই পাতা ছিল তাঁর আসন। রাজনীতি থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি, কূটনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই তাঁর বিচরণ ছিল স্বচ্ছন্দ। এই বিচিত্রগামিতা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোনও না কোনও ভাবে সজীব রেখেছিল। প্রাসঙ্গিকতা হারাতে দেয়নি।
বস্তুত প্রণববাবু কে, তার থেকে অনেক বেশি অর্থবহ হল প্রণববাবু কী! বহু জটিল রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে তিনি ছিলেন মুশকিল আসান। আবার কূটনৈতিক দক্ষতার নিরিখে তিনি বিশেষিত হতেন ‘চাণক্য’ অভিধায়। তাঁর উপস্থিতি, প্রভাব, পরামর্শ দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ স্তরে এই ভাবেই সমাদৃত হয়েছে। বীরভূমের গ্রাম থেকে উঠে এসে ক্ষমতার অলিন্দে দীর্ঘ কয়েক দশকব্যাপী এমন দৃপ্ত পরিক্রমণ বাঙালির কাছে তাঁকে রূপকথার নায়ক করে তুলেছে বললে তাই খুব ভুল হবে না।
বীরভূমের মিরিটি গ্রামে সাধারণ পরিবারে ১৯৩৫-এর ১১ ডিসেম্বর জন্ম প্রণববাবুর। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে দু’বার বিধান পরিষদে কংগ্রেস সদস্যও ছিলেন। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শুরু প্রণবের। নিজেই বলেছেন, ভরা বর্ষায় পরনের কাপড় খুলে গামছা পরে মাথায় বই-খাতা নিয়ে জল পেরিয়ে স্কুলে যেতে হত।
সিউড়ির কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কলেজেও পড়িয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যখন তাঁর পদার্পণ, তখন রাজ্যে অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা কংগ্রসের উত্থানপর্ব। অল্প দিন ওই দলের সঙ্গে ছিলেন প্রণববাবু। ১৯৬৯-এ মেদিনীপুরে লোকসভার উপনির্বাচনে নির্দল প্রার্থী ভি কে কৃষ্ণ মেননের জন্যও কাজ করেছিলেন। তাতেই ইন্দিরা গাঁধীর নজরে পড়েন এবং ইন্দিরার হাত ধরে যোগ দেন কংগ্রেসে। প্রণবের রাজনৈতিক জয়যাত্রার সেই সূচনা। ইন্দিরা সর্ব অর্থেই ছিলেন প্রণবের উন্নতির কান্ডারি। তাঁর পথপ্রদর্শক।
সংসদীয় জীবনের সিংহভাগ প্রণববাবু কাটিয়েছিলেন রাজ্যসভায়। ফলে সরাসরি জনগণের ভোটে জিততে হয়নি তাঁকে। সেই অপূর্ণতা মেটে ২০০৪ সালে। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে জিতে প্রথম লোকসভার সাংসদ হন তিনি। পরের বার ২০০৯-এর ভোটেও জয়ী হন সেখান থেকে।
কিন্তু সেই মেয়াদ ফুরানোর আগেই ২০১২ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি। বঙ্গসন্তানের মাথায় দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর মুকুটও প্রথম। তার আগে জাতীয় রাজনীতিতে প্রায় পাঁচ দশকের অভিযাত্রায় প্রণববাবু এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে গিয়েছেন। অপরিহার্য হয়ে উঠেছে তাঁর ভূমিকা।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ইন্দিরার অবদান চির দিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন প্রণববাবু। ১৯৭৩-এ প্রথম তাঁকে শিল্প মন্ত্রকের উপমন্ত্রী করেছিলেন ইন্দিরা। আনুগত্য, দক্ষতা, বিশ্বস্ততায় প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে নিজের আসন পাকা করে নিতে দেরি হয়নি প্রণবের। ইন্দিরা-অনুগত প্রণবের বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে শাহ কমিশনেও।
ইন্দিরা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে ১৯৮২ সালে প্রণববাবুকে অর্থমন্ত্রী করেন। তাঁর গগনচুম্বী অগ্রগতির আর একটি পর্ব শুরু এখান থেকে। পদ ছাপিয়ে গুরুত্বের দিক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ইন্দিরা মন্ত্রিসভার কার্যত দু’নম্বর। কংগ্রেসেও তাই। তাঁর প্রতি ইন্দিরার নির্ভরতা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রণববাবু কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানালে তা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বলেই গণ্য হত। প্রণবের ঘনিষ্ঠমহলে অনেকের অভিমত, খাতায়কলমে প্রধানমন্ত্রী না হয়েও প্রকৃতপক্ষে প্রায় প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বই প্রণব পেয়েছেন তখন। নিজে অবশ্য বলেছেন, কখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি।
যদিও অনেকের ধারণা, ২০০৪ ও ২০০৯-এ পর পর দু’বার মনমোহন সিংহকে সনিয়া গাঁধী প্রধানমন্ত্রী পদে বেছে নেওয়ায় কিছু বেদনা হয়তো প্রণববাবুর মনকে পীড়িত করেছিল। তবে থাকলেও তা ছিল অব্যক্ত। মনমোহনের সঙ্গে সম্পর্কের রসায়নে তার ছাপ বোঝা যায়নি।
ইন্দিরা গাঁধীর আমলে প্রণব যখন অর্থমন্ত্রী, তখন মনমোহন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হন। আবার সেই মনমোহনের নেতৃত্বেই দু’দফার ইউপিএ সরকারে পর পর প্রতিরক্ষা, বিদেশ এবং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রণব। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের আগে অর্থমন্ত্রী করা হয়েছিল প্রণবকে। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনোনীত হওয়া পর্যন্ত সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।
তবে এ সবের অনেক আগে প্রণবের রাজনৈতিক জীবনে বড় ছন্দপতন ঘটেছিল ইন্দিরার আকস্মিক হত্যার পরে রাজীব গাঁধী ক্ষমতায় আসার পরে। প্রণববাবু তখন আর মন্ত্রী নন। দলেও কোণঠাসা। হতাশায় কংগ্রেস ছেড়ে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গড়েছিলেন। কিন্তু দিল্লিতে বসে উঁচুতলার রাজনীতি করলেও নিজে দল গড়ার সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁর কোনও দিন ছিল না। ১৯৮৯-তে প্রত্যাবর্তন কংগ্রেসেই।
১৯৯১। নির্বাচন পর্বের মধ্যে রাজীব হত্যা। প্রধানমন্ত্রী হন নরসিংহ রাও। ধীরে ধীরে প্রণববাবু ফের সক্রিয়। যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে এই পর্বের যাত্রা শুরু। পরে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন। তবে রাও-এর অর্থনৈতিক সংস্কার পর্বের সঙ্গে পুরনোপন্থী প্রণববাবুর যোগ ছিল না। হয়তো রাও নিজেও সেটা চাননি।
সক্রিয় রাজনীতি থেকে পুরোপুরি সরে রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে যাওয়া প্রণববাবু মন থেকে মানতে পেরেছিলেন কি না, সেই প্রশ্নও আজ হাওয়ায় ঘোরে। কারণ রাইসিনা হিলসের ঘেরাটোপে ‘রাজসুখ’ থাকলেও দৈনন্দিন রাজনীতিতে সদা সক্রিয় মানুষটির পরিচিত দিনযাপনের কোনও সুযোগ সেখানে ছিল না।
বাংলার কংগ্রেস রাজনীতিতেও কয়েক দশক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছায়া ছিল অতি দীর্ঘ। মূলত দিল্লিতে থাকলেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হয়েছেন একাধিক বার। নিজস্ব গোষ্ঠীও ছিল তাঁকে ঘিরে। তবে সেই গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল প্রণববাবুর ক্ষমতার কারণে, তাঁর সাংগঠনিক যোগ্যতার জোরে নয়। আর তাঁর সেই ক্ষমতার সুবাদেই প্রণব-অনুগামীরা রাজ্যের কংগ্রেস রাজনীতিতে দড়ি টানাটানি করে গিয়েছেন কয়েক দশক।
তবে শেষ মূল্যায়নে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শুধুই কংগ্রেস নেতা বা কুশলী মন্ত্রী বললে সবটা বলা হবে না। একটি স্তরে উন্নীত হলে এক জন রাজনীতিক রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। প্রণববাবু সেই স্তর ছুঁয়েছিলেন। হয়তো তাই রাজনৈতিক বিতর্ক হবে জেনেও নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে গিয়ে বক্তৃতা করতে তাঁর বাধেনি।
প্রণববাবু বলতেন, ইন্দিরা তাঁকে শিখিয়েছিলেন, হাজার আঘাতেও কোনও দীর্ঘদেহী লোকের উচ্চতা কমে না। বিতর্ক, বিসংবাদের ঊর্ধ্বে ছোট চেহারার বড় মানুষটি সেই ভাবেই চিরজীবী হয়ে থাকবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy