সাম্প্রদায়িক রক্তে ভেজা পৃথিবীর ভূমি। মনুষ্যত্বের চরম অপমান চলছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। সাম্প্রদায়িক আচার সর্বস্ব নানা ধর্মগোষ্ঠীতে বিভক্ত মানব সমাজ। ধর্ম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করছে অনৈক্য ও বিবাদ। সম্প্রদায়গত ভাবে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে ধর্মকে। ধর্মের প্রকৃত মহিমা আজ একরকম মাটিতে পড়ে রয়েছে। ধর্ম এখন মারাত্মক এক হাতিয়ারে রূপান্তরিত। ধর্মের নামে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর উপরে নিজ মতবাদ চাপাতে উদ্যত। জন্ম নিচ্ছে হিংসা, দ্বেষ, রণ, রক্ত।
সকল ধর্মের মূল সুরটি প্রায় সমজাতীয়, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। কোনও এক সর্বশক্তিমান বিশ্বের নিয়ন্তা শক্তি। সকল ধর্মের সামাজিক নীতিগুলিও মোটামুটি একই ধরনের। যেমন, চুরি করা পাপ, মিথ্যে কথা বলা পাপ, অসৎ কর্ম করা পাপ ইত্যাদি। কোনও ধর্মেই অনাচার, ব্যাভিচার, মিথ্যাচার, পাপাচারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। নানা ধর্মের মধ্যে পার্থক্য শুধু পালনীয় আচার-আচরণে, ক্রিয়াকর্মে, নানা অনুষ্ঠানে। এ সবই ধর্মের বহিরঙ্গের পার্থক্য, অন্তরঙ্গে সব ধর্মই সমান; সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলে, মঙ্গলের কথা বলে। অথচ বিশ্ব জুড়ে স্বধর্মের আধিপত্য কায়েম করার জন্য প্রয়োজন হয়েছে ধর্মযুদ্ধের। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ’ নীতি সম্যক বলে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলোতে ধর্ম পালন নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, কিন্তু আমাদের বহু ধর্মের দেশ ভারতবর্ষের অবস্থা আদৌ সন্তোষজনক নয়। বহুত্বের মাঝে মিলনের সুরটি আজ বড় করুণ ও বেসুরে বাজছে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এদেশে কখনও কোনও ধর্ম প্রবল হয়ে উঠে অন্য ধর্মের কণ্ঠরোধ করেনি। কিন্তু বর্তমানে ধর্ম, রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে কলঙ্কিত করছে।
আমাদের দেশে শাস্ত্র ধর্ম মূলত আচার সর্বস্ব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ম এক পালনীয় কর্ম। ধর্মীয় মৌলবাদ ধর্মাচারের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে বিভক্ত করে, বিচ্ছিন্ন করে। ইংরেজ আমল থেকে আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়েছিল, আজ তা বৃহত্তর মৌলবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিছু অশুভ বুদ্ধির মানুষ ধর্মীয় গোঁড়ামিকে কাজে লাগিয়ে মৌলবাদের হাত শক্ত করছে। কিন্তু ধর্মান্ধদের সঙ্গে উদারমনা মানুষদের সংঘর্ষ যুগে যুগে চলেছে। প্রতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা স্বধর্মের গোঁড়ামিকে নিন্দা করেছেন ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণ করেছেন।
উদারহৃদয় লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং তা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাদের প্রাণ বিপন্ন হয়েছে। পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দয়ামায়া, ভালোবাসা, অহিংসা প্রভৃতি মানবিক গুণগুলোতেই বিশ্বাস রাখে। কিন্তু দুঃখের কথা হল, মৌলবাদের বিরুদ্ধে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের যে ভাবে রুখে দাঁড়ানোর কথা ছিল, যে প্রবল প্রতিবাদ প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু হয়নি। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে নিজে ধর্মের মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ধর্মের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা। স্বধর্মের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই স্বধর্মবিদ্বেষী হয়ে ওঠা। যেহেতু মৌলবাদ ধর্মীয় গোঁড়ামিকে সমর্থন করে, সুতরাং কিছু মানুষের কাছে স্বীয় ধর্মের মৌলবাদীরা প্রকৃত ধর্মরক্ষকের মর্যাদা পায়। তাঁদের মত ‘ধার্মিক’ মানুষের বিরুদ্ধতা করার অর্থ ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া, যা প্রকারান্তরে নাস্তিকতার শামিল। তাই সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ ভয় পান গোঁড়া মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যেতে। সে কারণেই আমাদের শিল্প-সাহিত্যে, সঙ্গীতে, বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। ধর্মকে পিছনে ফেলে মানবতার জয়গান খুব বেশি উচ্চারিত হয়নি। আমরা প্রকারান্তরে দ্বিজাতি তত্ত্বকে মেনে নিয়েছি। নজরুলের ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’ গান বা ‘সাম্যবাদী’র মতো কবিতা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। আমাদের জাতীয় আবেগে এ সমস্যাটি প্রাধান্য পায়নি। অথচ আমাদের এই উপমহাদেশে মৌলবাদ অন্যতম প্রধান গুরুতর সমস্যা। সমস্যাটি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের ভাবিত করলেও প্রতিবিধানের কোন জন্য কোন সদর্থক পদক্ষেপ তেমন দেখা যায় না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনও প্রাচীর গড়ে ওঠে না। পরিচয় পত্রে ধর্মীয় পরিচয় জ্ঞাপক ঘোষণাটি অবলুপ্ত হয় না।
কিন্তু শিষ্ট সাহিত্য, শিষ্ট শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি প্রবাহিত লোকসাহিত্যে, লোকগানে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানবতাবাদের জয়গান তুলনায় বহুলাংশে দেখা যায়। ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তাগণ হিন্দু বা মুসলিম কোনও ধর্মকেই স্বীকার না করে মানবধর্মের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন। লালন বা দুদ্দুর গানে জাত-সম্প্রদায়ের কাঠামো ভেঙে হিন্দু মুসলমানকে এক করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। লালন জাত-বর্ণহীন এক অসাম্প্রদায়িক মানব সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। একই পদ্ধতিতে সৃষ্ট মানুষের ধর্মীয় কারণে আলাদা হয়ে যাওয়া তিনি মানতে পারেননি। তিনি মানবজাতির মধ্যে জাতি, গোত্র, কুলের পার্থক্য; এমনকি লিঙ্গবৈষম্য মানতে পারেননি। তাই তিনি প্রথাগত সাম্প্রদায়িক ধর্মকে উপেক্ষা করে হিন্দু-মুসলমানকে এক করতে চেয়েছিলেন তাঁর গানে। তাঁর গানগুলি অসম্প্রদায়িক মানুষের মহামিলনের গান। নিম্নবর্গের শ্রমজীবী জনতার একটাই ধর্ম দারিদ্র। যে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনতা। তাই সাধারণ মানুষকেই প্রথম মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সাধারণ জনতাকে বুঝতে হবে ধর্ম পেটের ভাত জোগাড় করে দেয় না, রোগাক্রান্ত হলে পাশে দাঁড়ায় না, বাস্তবে নানা সমস্যায় দীর্ণ জীবনে কোনও সুরাহা ঘটায় না। মানুষের পক্ষে হিতকর যা কিছু করা যায় তাই ধর্ম, তাই পুণ্য। মানুষের ক্ষতি করার চেয়ে বড় অধর্ম আর কিছু হতে পারে না।
লেখক শিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy