১৯০৭। রোমের এক উপেক্ষিত জনবসতি স্যান লরেঞ্জোয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অতিশয় দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা কিছু পরিবারের অবহেলিত শিশুদের নিয়ে গঠিত হল ‘দ্য হাউজ় অব চিলড্রেন’। শিশুদের আচার-আচরণের উপর নির্ভর করে, শিশুকেন্দ্রিক এই শিক্ষা পদ্ধতির রূপকার হলেন মারিয়া মন্টেসরি। স্যান লরেঞ্জোয় প্রতিষ্ঠিত এই শিশু ভবনটি ক্রমে জনগণ ও সরকারের প্রশংসা অর্জন করল। পেশায় ডাক্তার ও মনোবিদ মন্টেসরির এই ব্যক্তিগত উদ্যোগ আজ গোটা দুনিয়ায় গঠনমূলক প্রাথমিক শিক্ষাপ্রণালী হিসেবে জনপ্রিয়। এ বছর মারিয়া মন্টেসরির জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হল। প্রসঙ্গত, ১৯৩৮-৩৯ থেকে দীর্ঘ সাত বছর মন্টেসরি ভারতে থেকে কাজ করেছিলেন।
আজ ভারতে মন্টেসরি স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মূলত বেসরকারি উদ্যোগে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এই পদ্ধতিতে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষালাভের পর প্রথাগত শিক্ষার পরিসরে নিজেদের মানিয়ে নিতে পড়ুয়ার কিছু অসুবিধে হয়, বিশেষত ভারতের মতো দেশে। তাই বুনিয়াদি স্তরে মন্টেসরি শিক্ষার বিস্তার প্রধানত দেশের বড় শহরগুলির অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে। স্যান লরেঞ্জোয় দরিদ্র শিশুদের কল্যাণার্থে মন্টেসরির দাতব্য উদ্যোগ ভারতের ক্ষেত্রে ক্রমশ মহার্ঘ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে শিক্ষার সুযোগ সহজলভ্য করার প্রয়াস যে হয়নি, তা নয়। মন্টেসরি প্রশিক্ষক রাধা নাগরাজ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরিচালিত বালসেবিকা শিবিরের একান্ত হিন্দু ঘরানার শিশুশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তামিলনাড়ু ও কর্নাটকের একাধিক শহরে পুরসভা পরিচালিত স্কুলে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শিশুশিক্ষার এই পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছে। ভারতে তিব্বতি শরণার্থীদের কয়েকটি স্কুলে নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে মন্টেসরি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, এই উদাহরণের সংখ্যা বেশি নয়। ভারতের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রারম্ভিক স্তরে শিক্ষাদানের যে পদ্ধতির পরিকল্পনা হয়েছে, তাতে মন্টেসরি পদ্ধতির ছাপ রয়েছে। কিন্তু, সরকারি উদ্যোগে সর্বজনীন শিশুশিক্ষার ঢালাও পরিবর্তনের মডেল হিসেবে এই পদ্ধতি ব্যবহারের কাঠামোগত পরিকল্পনা নতুন শিক্ষানীতিতে নেই।
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, খেলার মাধ্যমে শিশুদের শরীর ও মনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সংঘটিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক, নারী-শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক এবং আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগ একসঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু, দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতে যে সব স্কুল আছে, বিশেষ করে তাদের প্রাথমিক বিভাগগুলির বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে কোনও পর্যবেক্ষণ নেই। এই স্কুলগুলি এমনিতেই বেহাল, তার উপর আবার প্রাক্-প্রাথমিক বিভাগের খেলাঘর (প্লে হাউজ়) শিক্ষাব্যবস্থাকে তার সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা বেশ কিছু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের উদ্দেশ্যকে।
মন্টেসরি শিক্ষাপ্রণালীকে কার্যকর করতে হলে শিশুর খেলাঘর বা শ্রেণিকক্ষকে নতুন ভাবে সাজাতে হবে। আসবাব, শিশুর খেলনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশন দরকার। শিশুকেন্দ্রিক এই ধরনের পরিবেশ গড়ে তুলতে যাঁরা সাহায্য করবেন, তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। শিক্ষার উপযোগী খেলনা জাতীয় যে সব সামগ্রী শিশুদের জোগান দিতে হবে, সেগুলি তৈরি করা থেকে শ্রেণিকক্ষে সাজিয়ে দেওয়া পর্যন্ত, সব কিছুর দেখভাল করতে হবে এই বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষা-সহায়ক কর্মীদের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ঠিক কী ভাবে শিশুদের তত্ত্বাবধান করতে হবে, তা রপ্ত করা। এক বার প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে এ রকম শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশ তৈরি করতে পারলে স্কুলের পরবর্তী ধাপগুলোকেও সে ভাবে সাজাতে হবে, নতুবা স্তরের ভিন্নতা ও অসঙ্গতির কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব পড়ুয়াদের স্কুলছুট হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের শিশুশিক্ষার নতুন কার্যক্রমের উপযুক্ত করে তুলতে হলে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, তার সঙ্গে পরিকল্পিত চার বছরের স্নাতক স্তরের বহুমুখী বিএড শিক্ষার গোত্র কি এক হবে? ধরা যাক, মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে মন্টেসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হল, আর অন্য এক শিক্ষার্থী চার বছর ধরে স্নাতক স্তরে বহুমুখী শিক্ষার সঙ্গে বিএড পাঠ্যক্রমের মন্টেসরি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উভয়ের যোগ্যতা কিন্তু এক হবে না। সুতরাং স্কুলশিক্ষায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা গরমিল থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শেষ পর্যন্ত কত টাকা মিলবে, প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। নতুন নীতি অনুসারে প্রাথমিক ও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার পরিকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও নতুন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ বাবদ বিপুল খরচ হওয়ার কথা। কেন্দ্রের বকেয়া অর্থের অভাব এবং ঋণের বোঝায় জর্জরিত রাজ্যের কোষাগারের পক্ষে এই নীতি কার্যকর করার দায়িত্ব সামলানো বেশ কঠিন। কেন্দ্রের উদার এবং বিভেদহীন সাহায্য ছাড়া এই নীতি রূপায়ণের কাজ রাজ্যের পক্ষে দুরূহ। বেসরকারি অংশীদারির উপর নির্ভর করলে, তা কতটা গরিব মানুষের কাজে লাগবে, বলা শক্ত।
এ সব কারণেই হয়তো খসড়া নীতির এক অংশে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলেও ৩.৬ ধারায় একটা ফাঁক রাখা হয়েছে। অন্যান্য প্রথাগত প্রক্রিয়া বা শিশুর গৃহশিক্ষার ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তা হলে প্রাক্-প্রাথমিকের ধারণাটি কি আদৌ বাধ্যতামূলক থাকছে? না কি, শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষার নবীকরণের প্রকল্পটি পরিকল্পনার স্তরেই আটকে থাকবে?
হয়তো সেটাই উদ্দেশ্য। দেশের যাবতীয় দুরবস্থা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষাব্যবস্থার খসড়া তৈরি করে আমরা বোঝাতে চাইছি, আমরা কতটা সক্ষম। আর তার জন্যে মন্টেসরি ধাঁচের শিক্ষাপ্রণালীর কথা ভেবে অভিনব উদারতার প্রমাণ দাখিল করেছি।
ইংরেজি বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy