Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

জীবনের প্রান্তশেষে পৌঁছে কবির দৃষ্টিতে শান্তি পারাবার

২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ শেষ বারের মতো তাঁর স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতন ছেড়ে অসুস্থতার কারণে কলকাতা রওনা হলেন। পিছনে পড়ে রইল তাঁর প্রিয় ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, আশ্রম। লিখছেন সম্পদনারায়ণ ধর কিছু ক্ষণ আগেই শেষ বারের মতো কবিকে দেখে গিয়েছেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ও ডাক্তার ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়— অপরাধীর মতো তাঁদের ব্যর্থতা আর একরাশ হতাশা নিয়ে। বেলা সাড়ে বারোটায় আকাশবাণী কবির প্রয়াণসংবাদ ঘোষণা করে। সারা দেশ শোকস্তব্ধ। ঠাকুরবাড়ির বাইরে শোকার্ত মানুষের ভিড়— ক্রমশ জনসমুদ্রে পরিণত হচ্ছে। চলল অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। আকাশবাণী থেকে ইথারে ভেসে এল নজরুল ইসলামের কণ্ঠে স্বরচিত কবিতার লাইন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’।

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৯ ০৩:৪৭
Share: Save:

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এক বার বলেছিলেন— ‘‘রবীন্দ্র-বিহীন পৃথিবীতে বাঁচিতে হইবে ইহা আমি কল্পনাও করিতে পারি না।’’ কিন্তু কঠিন বাস্তব হল এই যে তাঁর জীবিত অবস্থাতেই তাঁর এবং বাঙালির হৃদয়ের প্রিয় মানুষ রবি অস্তমিত হলেন। দিনটা ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ (৭ অগস্ট, ১৯৪১)। ঘড়িতে তখন বেলা ১২টা ১০মিনিট। স্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। কিছু ক্ষণ আগেই শেষ বারের মতো কবিকে দেখে গিয়েছেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ও ডাক্তার ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়— অপরাধীর মতো তাঁদের ব্যর্থতা আর একরাশ হতাশা নিয়ে। বেলা সাড়ে বারোটায় আকাশবাণী কবির প্রয়াণসংবাদ ঘোষণা করে। সারা দেশ শোকস্তব্ধ। ঠাকুরবাড়ির বাইরে শোকার্ত মানুষের ভিড়— ক্রমশ জনসমুদ্রে পরিণত হচ্ছে। চলল অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। আকাশবাণী থেকে ইথারে ভেসে এল নজরুল ইসলামের কণ্ঠে স্বরচিত কবিতার লাইন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’।

বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ শুরু হল শোকযাত্রা। শবাধার বহন করে নিয়ে চলেছেন ক্ষিতীশপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাক্তার নলিনাক্ষ সান্যাল, প্রবোধকুমার সান্যাল প্রমুখ বিশিষ্টজন। পথের ঠিকানা পেয়ে যাই কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখনীতে— ‘‘পথিকের বাঁধা পথ আরও বেঁধে দেওয়া হয়েছে কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রিট, কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট হয়ে পথিক যাবে। তারই একটি মোড়ে নিরুপায়ের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি। দূর থেকে কানে আসছে বিপুল পরাজয়ের তুমুল জয়ধ্বনি! সহসা দেখা গেল মরণের কুসুম কেতন জয়রথ! মনে হল কী বিচিত্র শোভা তোমার— কী বিচিত্র সাজ!’’

মাত্র কয়েক দিন আগে ২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ শেষ বারের মতো তাঁর স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতন ছেড়ে অসুস্থতার কারণে কলকাতা রওনা হলেন। যাত্রার মুহূর্তে কানে ভেসে এল আশ্রমের ছেলেমেয়েদের গলায় গান— ‘‘আমাদের শান্তিনিকেতন—সে যে সব হতে আপন’’। পিছনে পড়ে রইল তাঁর প্রিয় ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, আশ্রমের ছেলেমেয়ে আর অগণিত বন্ধু ও আপনজনেরা। সেলুন-গাড়ি-সহ বিশেষ ট্রেনে কবি সদলবলে পৌঁছে গেলেন হাওড়া স্টেশনে। সেখান থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্মভিটায়— যেন ফিরে এলেন মায়ের স্নেহচ্ছায়ায়, মায়েরই কোলে। চিকিৎসকেরা অনেক আলোচনা করে ৩০ জুলাই অপারেশনের দিন স্থির করলেন।

আশি বছর বয়সে দেহের সব কষ্ট ও গ্লানি অনুভবে থাকলেও শল্যচিকিৎসায় ছিল তাঁর ঘোরতর আপত্তি। রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, তিনি কবি। তাঁর ইচ্ছে কবির মতো চলে যেতে। সহজে এই পৃথিবী থেকে ঝরে পড়তে চান শুকনো পাতার মতো। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছিড়ি করা কেন?

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মৃত্যুকে কি তিনি ভয় পেয়েছিলেন? আমাদের বিশ্বাস হয় না। তবে খুব অল্প বয়স থেকেই মানুষ, প্রকৃতি এবং সামগ্রিক ভাবে এই পৃথিবীকে তিনি ভালবেসেছিলেন। প্রথম জীবনেই তিনি লিখেছিলেন— ‘‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’’।

এরও আগে কবির লেখনীতে পাই— ‘‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যামসমান’’। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে। আবার, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবি উচ্চারণ করলেন— ‘‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি’’। সারা জীবন ধরে পৃথিবীকে ভালবাসার এই একই সুর তাঁর লেখায়। জীবনের প্রতি অগাধ আস্থা থাকলে তবেই তো অপারেশনের ঠিক আগের দিন তিনি লিখতে পারেন— ‘‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে এসেছে আমার দ্বারে’’ কবিতাটি। আবারও অবাক করে দিয়ে অপারেশনের দিন সকালে মহা আশঙ্কার মধ্যে শুয়ে থেকে মুখে মুখে রচনা করলেন তাঁর জীবনের সর্বশেষ কবিতা— যা লিখে নিয়েছিলেন রানী চন্দ। ‘‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী’’। আমাদের কাছে এ এক পরম বিস্ময়। পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের বেদনা হয়তো বা কখনও তাঁকে পীড়িত করে থাকতে পারে, কিন্তু মৃত্যুভয়ে ভীত হওয়ার মতো কোনও নিদর্শন তাঁর জীবনের চালচিত্রে কোথাও কখনও ধরা পড়েনি। বরং সাহসভরে তিনি বলতে পেরেছিলেন— ‘‘কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়’’।

ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ স্বজন হারানোর শোক, দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আঘাত এত পেয়েছেন, যা খুব কম মানুষকেই সইতে হয়। অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর ভাষায়— ‘‘ওঁর মতো সর্বংসহ লোক আর কেউ নেই’’। তবে মৃত্যুকে, শোককে তিনি জয় করেছিলেন। তাঁর জীবনে চলেছিল এক মৃত্যুমিছিল, মৃত্যুর শোভাযাত্রা। অতি অল্প বয়সে মা এবং তার কয়েক বছরের মধ্যেই নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হল। এর পর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কন্যা রেণুকা ও বেলা, কনিষ্ঠ পুত্র শমী, নাতি নীতু— একে একে সকলেই বিদায় নিয়েছেন। চলে গিয়েছেন আরও কত নিকট আত্মীয় বন্ধুজন। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েও দুঃখের আগুনে পুড়তে পুড়তে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু হল মানুষের জীবনের মহোত্তর উত্তরণ। জীবন ও মৃত্যু— এই দুইয়ের মিলনেই জীবনের পূর্ণতা। তাই মৃত্যুকে সহজে বরণ করে নেওয়ার সাহস তাঁর ছিল— ‘‘মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে/ সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে’’। রবীন্দ্রনাথ মরণকে প্রত্যাখ্যান করেননি— ‘‘ভরা আমার পরাণখানি/ সম্মুখে তার দিব আনি/শূণ্য বিদায় করব না তো উহারে/ মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।’’

মহাজীবনের প্রান্তশেষে পৌঁছে কবির দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় ‘সমুখে শান্তি পারাবার’। এই গানটি লিখে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত শিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে শিখিয়ে দিয়ে তাঁর কাছে কবির অনুরোধ ছিল কবির জীবিতকালে এই গানটি না গাওয়ার। কবির এই অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে এই গান নিজের কাছেই সঞ্চয় করে রেখেছিলেন শৈলজারঞ্জন। বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়। এ যেন চিরযাত্রীর বার্তাবাহী এক সঙ্গীত। শান্তিনিকেতনে মন্দিরের উপাসনায় সে দিন সমবেত কণ্ঠে তিন ছাত্রী ইন্দুলেখা ঘোষ, অমলা বসু ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় শৈলজারঞ্জন চোখের জলে গেয়ে ওঠেন এই গানখানি— ‘‘সমুখে শান্তি পারাবার/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’’

সঙ্গের ছবি: রবীন্দ্রনাথের শেয যাত্রা (উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

লেখক : টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সদস্য

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy