Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
education

শিক্ষিত হওয়ার এই তো সময়

স্টেটাস-সচেতন পড়ুয়াদের মানসিক বৈষম্য পরবর্তী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। 

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

গত এক দশক ধরে এক শ্রেণির স্কুলের বিজ্ঞাপন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় দুটো বিষয় স্পষ্ট— সম-মাত্রার স্কুলগুলোর মধ্যে ভাল ছাত্র টানার প্রতিযোগিতা আর শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। বিজ্ঞাপিত স্কুলগুলো সবই শহরকেন্দ্রিক, বা শহরের প্রান্তসীমায় বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। সেখানে ভর্তি হওয়ার খরচ, মাসমাইনে, আনুষঙ্গিক ব্যয় অনেক। এই শতকের শুরু থেকে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণে সারা দেশে প্রচুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগই বেসরকারি ও ব্যয়বহুল। পাশ করার আগেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে নামী কোম্পানিতে চাকরির বন্দোবস্ত পাকা। এর পাশাপাশি সেই সময় আইটি-আগ্রহী মধ্যবিত্ত এবং মধ্যমানের ছাত্রদের তাক করেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে বহু বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যার অনেকগুলোই পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা বন্ধের মুখে, মূলত আর্থিক কারণে ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে।

তিন দশক আগেও অর্থনৈতিক বিভাজনের ইঙ্গিত দিয়ে প্রায় সব ইংরেজি মাধ্যম ও কিছু বাংলা মাধ্যমের স্কুলকে বলা হত ‘বড়লোক’দের স্কুল। ইংরেজি-বলা স্মার্ট ছাত্র ছিল, পাশাপাশি বাংলা-বলিয়ে ছাত্ররাও পড়ত, কিন্তু পরস্পরের প্রতি ব্যবহারে ভেদাভেদ দেখা যেত না। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে অনেক অভিভাবক তাঁদের ছেলেমেয়েদের এই সব স্কুলে ভর্তির জন্যে উঠেপড়ে লেগে গেলেন, অন্যতম কারণ রাজ্য সরকারের শিক্ষানীতি এবং সাধারণ স্কুলের নিম্নমুখী মান। স্কুলে ভর্তি নিয়ে ঘুষ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ধরে কাজ হাসিল ইত্যাদি শুরু হয়ে গেল। এ থেকেই শুরু হয় বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক দায়ের অবনমন। অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসাকে লাভজনক বলে মনে করে পরে স্কুল খুলতে শুরু করে। সমাজের ত্রিস্তরীয় আর্থিক অসাম্য আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল শিক্ষাক্ষেত্রেও। বিত্তশালীদের জন্যে শহরে বিলাসবহুল ইংরেজি মাধ্যম স্কুল; শহরাঞ্চল ও জেলার টাউনে মধ্যবিত্তদের জন্য প্রাচীন উচ্চমানের ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম সরকারি-বেসরকারি স্কুল আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্যে বাংলা মাধ্যম সাধারণ স্কুল, যার মধ্যেও কিছু স্তরভেদ আছে। নতুন গড়ে ওঠা স্কুলে কী কী আছে? বিজ্ঞাপনেই লেখা: কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার তিন বা পাঁচ তারার স্কুল, এসি বাস, জিম, টেনিস লন, সুইমিং পুল ইত্যাদি। সাধ্যের বাইরে গিয়েও অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের একটু ‘আরাম’-এ স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করতে পিছপা হন না। ভাল বেতনে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের ফলে বোর্ডের পরীক্ষায় ফল ভাল হতে থাকে। এ দিকে আগে যত ‘ক্ল্যাসিকাল’ স্কুল ছিল, তারা এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে থাকে, যদিও বোর্ডের পরীক্ষায় তাদের ফলও ভাল। আর্থিক সচ্ছলতা ও ভাল মেধার ছাত্র— এই সব স্কুল আর পায় না।

প্রাচীন কালের আশ্রমিক শিক্ষার ভাবধারায় বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ স্কুল চালু করলেও, সাধারণ ভাবে চার দেওয়ালের মধ্যে শিক্ষাকে বেঁধে দেওয়ার প্রস্তুতি অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতির মধ্যে থেকে প্রকৃতিপাঠ ও অন্যান্য শিক্ষা ছিল রবীন্দ্রনাথের আদর্শ। শহরে স্থানাভাবে প্রকৃতির মধ্যে পঠনপাঠন সম্ভব হল না, শিক্ষা থেকে গেল বই মুখস্থ ও পরীক্ষার খাতায় উগরে দেওয়ার মধ্যে। নানা বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তোলা, হাতে কলমে ব্যবহার, যুক্তি দিয়ে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া— হারিয়ে গেল। স্বাধীনতার পর উচ্চশিক্ষা প্রাধান্য পাওয়ায়, পরিকল্পনা ও আর্থিক বিনিয়োগ দুই ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার কর্মসূচি ব্যাহত হয়। আজও একটা সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক ও ব্যবহারযোগ্য রূপরেখা তৈরি হল না, যার ফলে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম এত ভিন্ন। শহুরে শিক্ষাব্যবস্থা গ্রামীণ খোলামেলা জায়গাকেও দখল করল, ফলে গ্রামে প্রকৃতিপাঠের যে সুযোগ ছিল, শহুরে পাঠ্যক্রমের চাপে তা-ও নষ্ট হল। সার্টিফিকেট হয়ে উঠল চাকরির প্রবেশপত্র।

অল্প বয়সে শারীরিক ক্লেশ সহ্যক্ষমতা বেশি থাকে, কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম সেই শক্তিকে মজবুত করে। সেই সময়েই পড়ুয়াকে ‘যুদ্ধ’ থেকে সরিয়ে আবদ্ধ পরিবেশে আরামে বড় করে তোলা হলে পরনির্ভরতা বাড়ে, আত্মশক্তি দুর্বল হয়। স্টেটাস-সচেতন পড়ুয়াদের মানসিক বৈষম্য পরবর্তী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলে।
অতিমারি ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ করে দিয়েছে প্রচলিত পাঠ্যক্রমের বাইরেও কিছু বিষয় সম্পর্কে জানার। বাড়িতে ভার্চুয়াল ক্লাসের পরে তাদের প্রকৃতিপাঠে আগ্রহী করা যেতে পারে। রাতের আকাশ এখন স্পষ্টতর, গ্রহ-নক্ষত্রদের সহজে চেনা যায়। আর্থসামাজিক বৈষম্যে অনেক ছাত্র লেখাপড়া করতে পারছে না, শিশুশ্রম বেড়ে যাচ্ছে, এই সময়ে এই বিষয়ে মতামত প্রকাশে উৎসাহ দিলে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়বে। পাঠ্যক্রম ছাড়াও নন-ফর্মাল শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ জাগালে, ধ্রুপদী বই পড়ার অভ্যেস কিংবা কল্পনাশক্তি বাড়ানোর পন্থা অনুশীলন করালে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে বাধ্য। শিক্ষিত হওয়ার এই তো সময়!

অন্য বিষয়গুলি:

Education Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy