Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

গঞ্জনা নয়, ওদের সমস্যা বোঝাটা বেশি জরুরি

মেয়েদের ফেলের হাত থেকে রেহাই দিতে পদক্ষেপ করা দরকার। অকৃতকার্যদের মতামত নিয়েই সে মডেল নির্মাণ হোক। ওদের উপর একটু বেশি করে আলো পড়ুক। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামসুযোগের দরজা মেয়েদের  জন্য প্রশস্ত না করতে পারলে পাশের হারও জায়গা বদল করবে না।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯ ০১:১৮
Share: Save:

ফেল করেছ?

—‘হ্যাঁ, মাস্টার নম্বর দেয়নি।’

—স্কুল যেতে প্রতিদিন?

—‘না, ভাল লাগত না।’

—কেন?

—‘ক্লাস হত না!’

—তবে বাড়িতে পড়লে না কেন? রোজিনার উত্তর, ‘‘বাড়িতে পড়ার পরিবেশ নেই। আমার মা-কাকি কেউ পড়া জানে না। কেউ বাড়িতে পড়তেও বলে না!’’

তবে কি স্কুলের পোশাক, সাইকেল এ সবের জন্যই বাড়ি থেকে বিদ্যালয় যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়? লেখাপড়া শিখে বড় হও— এ কথা কেউ বলেইনি কোনওদিন! শিক্ষা অর্জন নিয়ে পরিবারে কারও মাথাব্যথা নেই তবে! এক পিতাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘‘মেয়েদের লেখাপড়া মায়েরাই দেখে। এটা তো মহিলাদেরই দায়িত্ব!’’

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, বাড়ির পুরুষ অভিভাবকের উপরে কি মেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব নেই? পড়াশোনার দায়িত্ব যখন মা কিংবা গৃহশিক্ষক নিতে পারছেন না তখন সে দায় বাবা নিজের কাঁধে তুলে নিলে সমস্যা কোথায়? সংসারে পরিশ্রম করে মা মেয়েদের দেখাশোনা করছেন। কিন্তু তিনিও সব সময় সফল হতে পারছেন না। ফলে অভিভাবক হিসেবে বাবার দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার কথা। কিন্তু তা সাধারণত হয় না।

একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, মেয়েদের কাছে অ্যাকাডেমিক প্রত্যাশা তুলনামূলক কম। জেন্ডার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার ধারণা মেয়েদের ঘরে–বাইরে-বিদ্যালয়ে দেওয়া হতে থাকে। শুরুতেই জানান দেওয়া হয় যে, ছেলেরা সব পারে কিন্তু মেয়েরা তো সব পারে না! রাজপথ ও গলির তফাৎ জেনেই তাকে বড় হতে হয়।

পরীক্ষার প্রস্তুতি না থাকার কারণে অকৃতকার্য হওয়া স্বাভাবিক। অসুস্থতার কারণে বা পারিবারিক কারণেও সেটা হতে পারে। শিখন প্রক্রিয়ায় ঘাটতিও থাকতে পারে। কিন্তু সব দোষ এক ১৪/১৫ বছরের মেয়ে মাথায় নিয়ে চোরের মতো কেন লুকিয়ে বেড়াবে? সমাজ থেকে সে যা শিক্ষা পায় তা তাকে পড়াশোনায় বড় হতে উৎসাহিত যতটা করে তার চেয়ে বেশি গৃহকর্মে পারদর্শী হতে শেখায়। নিজেকে প্রতিপালনের জন্য উপযুক্ত জীবিকা অর্জনের বাধ্যতা কেউ তুলে ধরে না। নিজেকে মজবুত করার বদলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে এগোতে হয়। বিধিনিষেধের ফর্মুলা শিক্ষা অর্জনের থেকে জরুরি বলে শেখানো হয়। যা প্রচার করা হয় তা বিশ্বাসের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় না। মেয়েদের উন্নতি চাওয়া হয় কিন্তু উন্নতির পথের বাধাগুলো সময় মতো সরানো হয় না। পড়তে হবে বলা হয়। কিন্তু ঘরের কাজে ব্যস্ত করে দেওয়া হয়। এমনকি নিয়মিত নজর রাখা হয় না মেয়েদের কর্মদক্ষতায়। কর্মদক্ষতার সঙ্গে মেয়েদের শিক্ষা নয়, পারিবারিক কাজের ব্যবহারিক দক্ষতাকে মানা হয়।

বাড়ি থেকে না বেরোনো ‘ভালো মেয়েটি’ যে এক পূর্ণ মানবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে— এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় না। আমার মেয়ে ‘সব রান্না পারে’-র মধ্যে কখনও ভুলেও শোনা যায় না যে, মেয়ে ‘অঙ্ক কিংবা ভৌতবিজ্ঞানটাও দারুণ পারে।’ মেয়ে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার সব প্রাথমিক শর্ত থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এ ভাবেই। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেল করার কুফল আরও স্পষ্ট হয়। ফেল করার পরে পরিবর্তন আসে অকৃতকার্যদের ব্যবহারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে তাদের বিরক্তি শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি থাকলেও পরে তা সামাজিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। নানা মানসিক সীমাবদ্ধতার মুখে তাদের পড়তে হয়।

মিডিয়া ও গণমাধ্যমগুলি সচেতন নয় এই বিষয়ে। ফেল করা মেয়েদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা ও তাদের মনোবল বাড়ানোর কাজ সে ভাবে করা হয় না। অকৃতকার্য মেয়েদের নিয়ে কাউন্সেলিং জরুরি। পরিবারের অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে যুক্ত করা প্রয়োজন। তাদের লজ্জা ও সম্মান বোধের সঙ্গে ফেলের যে অস্বাস্থ্যকর সংযুক্তি তা থেকে তাদের প্রাথমিক ভাবে মুক্ত করা দরকার। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া অনুত্তীর্ণের উপর চাপ বাড়ায়। পরিবারের হেনস্থার কারণ সে— এটা ভেবে তার আত্মবিশ্বাসও ক্রমশ

কমতে থাকে।

সম্পত্তির অধিকার, বৈবাহিক পদ্ধতির বসবাসের নিয়ম এবং গ্রামের বাইরে চলে যাওয়া-সহ মিলিত শ্রমের লিঙ্গ বিভাগ মেয়েদের অকৃতকার্যতাকে প্রসারিত করে। বাবা-মায়েরা মূলধন হিসাবে তাদের কন্যাদের পড়াশোনায় সম্পূর্ণ ভাবে বিনিয়োগের প্রেরণা পায় না। ফেল করা মেয়েদের জীবন অবহেলার চক্রাবর্তে ঘুরতেই থাকে। ইচ্ছা থাকলেও ফেল হওয়ার ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারে না পরীক্ষার্থী। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে যে ধ্বংসাত্মক বিষয় তা প্রতিরোধ করতে পারে। প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময় ব্যর্থ হয়। কিন্তু চেষ্টা ছেড়ে দেওয়াটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যর্থতা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। পরীক্ষায় ফেল করার সঙ্গে ব্যর্থতাকে যুক্ত করা খুব নিরর্থক। সেই ব্যর্থতার সঙ্গে যে গ্লানি তা এক মেয়ের প্রাপ্য নয়।

সাইকেল, পোশাক, খাতা, ব্যাগ, চশমা, কন্যাশ্রী বালা, নিজের ব্যাঙ্ক আকাউন্টে টাকা এ সব আসলে কী জন্য? পড়ার উদ্দেশ্য যদি সফল না হয়, শিক্ষা যদি অসম্পূর্ণ থাকে তবে কেন এই উপকরণ? বিয়ে বন্ধ ও স্কুলছুটের মোক্ষম দাওয়াই কন্যাশ্রী, এটা মেনে নিয়ে আত্মতুষ্ট হওয়ার কোনও জায়গা নেই। কেননা বাল্যবিবাহ এখানে অব্যাহত। বিবাহিত মেয়েও কন্যাশ্রীর টাকা পাচ্ছে নিয়মের ফাঁক গলে। শুভেচ্ছা বার্তার কাগজ নষ্ট হচ্ছে কিন্তু মেয়েরা শিখছে না। কন্যাশ্রীরা ‘যোদ্ধা’ হয়ে গেল কিন্তু পরীক্ষা, মানে মূল লড়াইয়ের জায়গায় নিরস্ত্র হয়ে থাকল। অকালে বিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেল না তারা। স্বামীর অনুদানের জীবন নয়, নিজের জীবিকা অর্জন সম্মানের। এই বোধ গড়ে তোলা গেল না কিছুতেই। এক লক্ষ্যহীন, আত্মপ্রত্যয়হীন জীবন আবার অকৃতকার্যতার বোঝা কাঁধে নিয়ে ফেলল।

সাইকেল প্রশংসনীয় কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। কারণ, তা অকৃতকার্যতা রোখার ক্ষীণ দিশামাত্র, সমাধান নয়। খাতা, বই, ব্যাগ নিয়েও মেয়েদের উৎসাহের ভাটায় প্রতিরোধ টানা গেল না! ‘তুই মেয়ে, তোর পড়ে কী হবে? ছেলেরাই চাকরি পাচ্ছে না। মেয়েদের আর কী হবে? ফেল করেছিস আর পড়তে হবে না।’ এই গঞ্জনার মুখে একটি মেয়ের সামনে তখন দু’টি বিকল্প। লড়াই করে দেখিয়ে দেওয়া নয়তো চুপ করে ভিড়ে হারিয়ে থাকা। প্রথম ক্ষেত্রে সাফল্য কম। কেননা একসঙ্গে বহুমুখী লড়াইয়ে এক অপ্রাপ্তবয়স্কর জেতা কঠিন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অকাল বিবাহ, তার পরে অকাল সন্তান প্রসব, অকালে অসুখে পড়ে রোগভোগ। তারপর পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েটিকে হার অনুশীলন করতে শেখানো। এর থেকে সামাজিক নিষ্কৃতি পেতে হলে যে বিশ্বাস ও স্বার্থের প্রয়োজন তা গড়ে তোলা এক দিনের কাজ নয়। কিন্তু সমাজের কুভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে পারাটা মানুষের নিয়ন্ত্রণে। নইলে মেয়েদের অবস্থার উন্নতি কিছুতেই হবে না। সুযোগের দরজা মেয়েদের জন্য প্রশস্ত না করতে পারলে পাশের হারও জায়গা বদল করবে না। ‘আগের থেকে এগিয়েছে’— এই কথাটা মধ্যযুগীয়, চলমান সভ্যতার পক্ষে হানিকর। প্রোগ্রেস বা উন্নতি দেখা যায়। খুঁজে বের করতে হয় না। মেয়েদের উন্নতি পাশের হারে প্রদর্শিত হচ্ছে না। তাই আগের থেকে সাফল্য বেড়েছে বলে আগামীর অপেক্ষায় বাকিটা ফেলে না রেখে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি। মেয়েদের ফেলের হাত থেকে রেহাই দিতে পদক্ষেপ করা দরকার। অকৃতকার্যদের মতামত নিয়েই সে মডেল নির্মাণ হোক। সেই মেয়েগুলোর উপর একটু বেশি করে আলো পড়ুক। জীবন থেকে বিদ্যালয়ের হিসেবের একটি বছর চুরি যেন না যায় তাদের। (শেষ)

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

অন্য বিষয়গুলি:

Feminism Gender Failure
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy