আগে কোথাও যাওয়ার জন্য স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে অনুমতি চাওয়ার সাহসই হত না।” কিন্তু এক দিন সেই সাহস হল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফ্রেজ়ারগঞ্জের প্রীতিকণা বেরার। ২০২১-এ ডিসেম্বরের এক সকালে সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা ব্লকের জি প্লট-এ একটি কৃষক সম্মেলনে যখন তিনি হাজির হলেন, তখন তাঁর “বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, সত্যিই আমি পরিবার ছাড়াই একা গ্রামের বাইরে যেতে পেরেছি।” সেই একলা বেরোনোর সাহসই তাঁকে ক্রমে শেখাল কম জলে কী ভাবে জৈবসার ব্যবহার করে মরসুমি দেশি আনাজের চাষ করা যায়। কী ভাবে নোনা জলেও ধান চাষ হয়। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনেও জীবন ও জীবিকা যাতে তত সমস্যায় না পড়ে, সেটাও শেখাল। এবং মাত্র এক বছরের মধ্যেই সনাতন গৃহবধূ থেকে নিজেকে ‘কমিউনিটি রিসোর্স পার্সন’-এ রূপান্তরিত করে ফেললেন প্রীতিকণা।
ওই জি প্লটের শিবানী দাসও শিখলেন, সুন্দরবনের ক্ষয়িষ্ণু বাদাবন পুনরুজ্জীবনের জন্য কাঁকড়া, বাইন, গরান ইত্যাদি গাছের বীজ সংগ্রহ করে বাদাবন তৈরি ও সামাজিক বনসৃজনের কাজ। ক্রমশ তাঁর অভিজ্ঞতা হল, “আগে বছরে দু’-তিন বার করে বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে যেত, চাষ হত না। এখন আর বাঁধ ভাঙে না।” প্রীতিকণা, শিবানীরা শুধু যে নিজেরাই শিখেছেন তা নয়, এলাকায় অন্য মহিলাদেরও এখন রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কলকাতায় জলবায়ু নিয়ে একটি সম্মেলনে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
ওই সম্মেলনে যোগ দিতে আসা মিলি দাস, মধুমিতা মাইতি, সুমিত্রা খাঁড়াদের কাছে শুনছিলাম, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চরম প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে তাঁদের লড়াই করে টিকে থাকার কথা। মনে হচ্ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘন ঘন বিধ্বংসী ঝড়, প্লাবনে সুন্দরবনের বিপর্যস্ত এই প্রান্তিক মানুষজন এত দিনে হয়তো সেখানে টিকে থাকার কিছু উপায় খুঁজে পাচ্ছেন। বিশেষ করে যাঁরা পরিযায়ী খাতায় নাম না লিখিয়ে ভিটেমাটি কামড়ে পড়ে থাকছেন, তাঁরা অনেকেই পায়ের নীচের সেই মাটিকে শক্ত করে তুলছেন। তাঁদের সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ওই সংস্থা।
যেমন সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা ব্লকের সুজাতা, মিলি, কৃষ্ণারা মিউচুয়াল কোঅপারেশন গ্রুপ তৈরি করে ২০২১ সাল থেকে নানা স্থানীয় দেশি শস্যের বীজ সংগ্রহ করে বীজ ভান্ডার তৈরি করছেন। কয়েক লক্ষ টাকার ১৮-১৯ রকমের বীজ বিক্রিও করেছেন। গড়ে তুলেছেন ৪০০০ নার্সারি। সেই নার্সারির লাগানো ‘নদী বাঁধের গাছ কোথাও ৪-৫ ফিট, কোথাও ১০-১২ ফিট লম্বা হয়ে গেছে। প্রচুর পাখিও আসছে এখন, বলছেন তাঁরা। আরও বলছিলেন, “যে ২৪ হাজার ম্যানগ্রোভ গাছ লাগিয়েছি, জলের মধ্যে তার শিকড়ের ফাঁকে অনেক মাছ হচ্ছে যা আমাদের জীবিকা জোগাচ্ছে। তা ছাড়া সহনশীল পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে আমাদের জীবনের মান বেড়েছে। বিষমুক্ত খাবার খেতেও শিখেছি।” বস্তুত এই প্রান্তিক মহিলাদের সচেতনতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্থানীয় পরিবেশে যেমন কিছু পরিবর্তন ঘটছে, তেমনই তাঁদের আর্থিক অনিশ্চয়তাও কিছুটা কাটছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মেরুপ্রদেশে দ্রুত বরফ গলে সমুদ্রের জলতল উঁচু হয়ে ওঠায়, পৃথিবীর অন্যত্র উপকূল অঞ্চলের মতো সুন্দরবনেও দ্বীপ ও উপকূলে তার আগ্রাসন ঘটছে। অপর দিকে সুন্দরবনে নদীর ধারে ধারে মীন (চিংড়ির পোনা) ও কাঁকড়া ধরা, গবাদি পশুর চারণ, গাছ কেটে চিংড়ির খামার গড়ায় ক্রমশই ধ্বংস হতে বসা ম্যানগ্রোভের রক্ষাকবচটি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে সেই বিপর্যয়ের গতির হার কিছুটা ধীর করা গেলে সুন্দরবনবাসীদের পক্ষে তা হয়তো খানিক সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই কাজে সর্বাগ্রে জরুরি, কী ভাবে সুন্দরবনের বাদাবনকেন্দ্রিক বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্রমবর্ধমান ধ্বংস প্রতিরোধ করে সংরক্ষণ করা যায়— সে সম্পর্কে সেখানকার মহিলাদের মধ্যে সম্যক ধারণা ও সচেতনতা গড়ে তোলা। নেচার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি’র জয়েন্ট সেক্রেটারি ও প্রোগ্রাম ডিরেক্টর অজন্তা দে বলছিলেন, “২০০৯-এ আয়লার বিধ্বংসী বিপর্যয়ের পর বাদাবন তৈরির জন্য কমিউনিটি মডেলে দুলকি, আমলামেথি, মথুরাখণ্ডে আমরা প্রথম কাজ শুরু করি। মহিলাদের গ্রুপই বীজ সংগ্রহ করে, কোথায়, কী গাছ লাগানো হবে তা ঠিক করে। এ ভাবেই সুন্দরবনে প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টরে গাছ লাগানো হয়েছে। ১৮৩টি প্লান্টেশন সাইটে ২৫ মহিলা গ্রুপ ও ১২২ জন স্টুয়ার্ড-এর অভিভাবকত্বে সেই বাদাবন রক্ষা করা হচ্ছে।”
এই রক্ষার কাজটি না হলে বাদাবন এক দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। তাই এই মহিলারা যেখানে বাদাবনের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর ও পরিবেশ উপযোগী চাষাবাদের সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মোকাবিলায় লড়াইটাও চালাতে পারছেন। তাঁদের জেদ, অপার আত্মবিশ্বাস পরিবারে, সমাজে তাঁদের অবস্থানও বদলে দিচ্ছে। প্রীতিকণা, সুজাতা, শিবানীদের শরীরী ভাষায় সেই বদলেরই হিরণ্ময় ছটা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)