করোনাভাইরাস মরতে আসেনি, মানবশরীরে ঘাঁটি গেড়ে বাঁচতে এসেছে। একের পর এক করোনা প্রতিরোধী টিকা এসেছে, কিছু ভাইরাসরোধী ব্যবস্থাও। করোনাও নিজেকে ক্রমাগত বদলে ফেলেছে দ্রুত, হয়ে উঠছে প্রতিষেধক-অবিচল। দুর্ভাগ্য মানুষের, বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য দু’টি ফুসফুস ও অন্য কিছু জরুরি অঙ্গ করোনার অতি প্ৰিয় খাদ্য। কোভিডের দু’টি ডোজ় টিকা নেওয়ার পর অসংখ্য মানুষ বিজয়ীর হাসি হেসেছেন, হাতে টিকার সুদৃশ্য একটা সার্টিফিকেট। তাতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি, পাশে বাণী, ‘দাওয়াই ভি, কড়াই ভি’। বঙ্গসন্তান ‘কড়াই’ বলতে উনুনে বসানো এক রন্ধনপাত্র বোঝেন। সেই ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ের কথা নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী বলেননি, বলেছেন কড়া বিধি মেনে চলার কথা। কিন্তু টিকা বা প্রতিষেধককে ‘দাওয়াই’ বলাটাও কি ঠিক হল? টিকা ওষুধ নয়, রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে মাত্র। কোভিডের কোন ভ্যাকসিন কতটা প্রতিরোধ বাড়ায়, যথেষ্ট গবেষণা এখনও হয়নি। কোভিডের ভ্যাকসিনকে ‘করোনার ওষুধ’ বললে বিভ্রান্তি তৈরি হয়! দেশের শাসক যদি ওষুধ আর প্রতিষেধক গুলিয়ে ফেলেন, তা হলে সাধারণ মানুষ দু’ডোজ় ভ্যাকসিন নিয়ে পুচ্ছ তুলে, মাস্ক খুলে, উৎসবের ভিড়ে নাচলে দোষ দেওয়া যায় কি?
কোভিডের দুটো টিকা নিলে কোভিড আর হবে না, এমন পরোক্ষ আশ্বাস মানুষের মনে বিপজ্জনক এক ছদ্ম-নিরাপত্তার জন্ম দিয়েছে। হাসপাতালে পর্যন্ত বহু রোগী ও তাঁদের পরিজনের মাস্ক থুতনিতে। অতিমারির শুরুতে এঁদেরই অনেককে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বললে ‘ও সব ডাক্তাররা বলে থাকে’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন। আজ তাঁরাই জানতে চাইছেন, “ভয় নেই তো ডাক্তারবাবু?”
হ্যাঁ, ভয় আছে। আতঙ্ক নয়, তবে একটু ভয় যদি কাণ্ডজ্ঞান ফেরায় এই ক্রান্তিকালে, মন্দ কী? সংক্রমণ বাড়ছে— ২১ অক্টোবর রাজ্যে কোভিডে সংক্রমিত আটশো তেত্রিশ জন। জুনের শেষে যা দেখা গিয়েছিল, তার পর এ এক ভয়ঙ্কর রেকর্ড। শুধু কলকাতায় সে দিন কোভিডে মৃত্যু হয়েছে পনেরো জনের। রোজই রাজ্যের সব জেলায় আক্রান্ত হচ্ছেন কয়েকশো মানুষ। গত তিন মাসে দুটো ডোজ় ভ্যাকসিন পেয়েও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন কয়েকশো। দুটো টিকা মানেই নিজেকে ‘মুক্ত’ ভাবার ঝুঁকিটা এখনও অনেকে বুঝতে পারছেন না, এটা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়।
কোভিডে মৃত সহকর্মী-চিকিৎসকের মুখগুলো ভেসে উঠছে মনে। তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ইমার্জেন্সিতে আসা যন্ত্রণাকাতর রোগীরা স্মৃতিতে ফিরে আসছেন আবার। রোগীর সামনে কাঁদতে নেই ডাক্তারদের। কোভিডের মৃত্যু চোখ ভিজিয়ে দেয় দিনান্তে, বাড়ি ফিরে। মনে পড়ে কত মাতৃহারা, পিতৃহারা সন্তানের মুখ। উল্লাস, উল্লাস, তোমার স্মৃতি নাই মানুষ? স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে না গঙ্গায় ভেসে আসা সেই লাশগুলি! মনে পড়ে না গণচিতা, ধাপার চুল্লি, জাতির বিবেক কবির মৃত্যু! উৎসব ফিরে ফিরে আসে। কোভিডে মৃত মানুষগুলোই শুধু ফেরেন না আর কোনও দিন।
সবজান্তা বাঙালির আত্মঘাতের কোনও শেষ নেই। অতিমারির তৃতীয় ঢেউ, ‘থার্ড ওয়েভ’ সামনেই— এই সতর্কবাণী কবে থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। অথচ কেউ কান দেয়নি, তা বোঝা গিয়েছে পুজোর বাঁধভাঙা ভিড়ে। অতএব আজ রোগী বাড়ছে। কোভিড ওয়ার্ডের ফাঁকা বেডগুলো ভরে উঠছে একটু একটু করে। ফের রোগী ঢুকছেন কোভিড সিসিইউ-তে। আক্রান্ত হতে শুরু করেছে শিশুরাও। এ রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোভিডের দুটো বড় ধাক্কা সামলে দিয়েছে। সারা রাজ্যে শিশুদের জন্য কোভিডের পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রায় শেষ। কিন্তু অসুস্থ সন্তানের রোগমুক্তির জন্য মুহূর্ত-ঘণ্টা-দিন যখন গুনতে হবে, তখন কি পুজোর সাজ, পুজো মণ্ডপে ঢোকার জন্য বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের স্মৃতি সান্ত্বনা দেবে? লাঘব করবে উদ্বেগ?
এ বার অন্তত সামলে চলার সময় এসেছে। কোভিড ফের ছড়াচ্ছে। নাকঢাকা মুখাবরণী থাক মুখেই। অকারণে বাইরে বার হওয়া বন্ধ হোক অন্তত কয়েক সপ্তাহ। অসংখ্য মানুষ বন্যাকবলিত, কর্মহীন আরও অনেকে। প্রান্তিক মানুষের পিঠ দেওয়ালে। ওঁদের পাশে দাঁড়ানো হোক উৎসবের অবিমৃশ্যকারিতার প্রায়শ্চিত্ত। জীবিত ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীদের বাঁচানো জরুরি। শারীরিক দূরত্ব বজায় থাক। জরুরি বয়স্ক মানুষের যত্ন, ডায়াবিটিস, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। ফুসফুসের, কিডনির রোগ থাকলে, অচেনা উপসর্গ থাকলে পরীক্ষা করান দ্রুত। ভুলবেন না, পুজোর প্যান্ডেলে তোলা সেলফিতে আপনার পিছনে অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল করোনার ভাইরাসও। কোভিড-যোদ্ধা চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা তো আপনার পাশে থাকবেন আমৃত্যু।
আর জি কর মেডিক্যাল হাসপাতাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy