জীবনানন্দ দাশ কবিতায় যে নারীকে খুঁজেছেন, তাঁর গদ্যে কেন তার বিপরীত নারীরা উঠে এসেছেন? গ্রাম্য, ক্রূর, ক্ষমাহীনা, নিষ্ঠুরা যে নারীদের আমরা রক্ত মাংস ক্লেদ সমেত পাই তাঁর গল্পে ও উপন্যাসে, তাঁদের উৎস ব্যাখ্যা করতে বসলে খেই হারায় মন।
নারী কেন দুই চূড়ান্ত বিপরীত মূর্তিতে একই সাহিত্যচেতনার আধারে উপস্থাপিত হয় বার বার, এ প্রশ্ন আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। কেননা, আমরা যারা বিশ্বাস করি যে, খাটের নীচে ট্রাঙ্ক-ভর্তি অপ্রকাশিত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি রেখে যাওয়া জীবনানন্দের এই গদ্যগুলি বস্তুত তাঁর কবিতানির্মাণের পশ্চাৎপট, তাঁর খসড়া খাতা, তারা মেলাতে পারি না এই তথ্য: কবিতায় সুরঞ্জনা, বনলতা, সবিতাদের যে তুমুল উচ্চতায় তিনি উঠিয়েছিলেন, স্নিগ্ধতায় উদ্ভাসিত করে; উপন্যাস ও গল্পগুলিতে, চাঁদের উল্টো পিঠের কলঙ্কের মতোই, তিনি বসিয়ে দিয়েছেন উৎপলা বা কল্যাণীদের।
বিশ শতকের নিজস্ব হস্তাক্ষর কী? অজস্র যুগলক্ষণের একটি, নারী-পুরুষের প্রেমের প্রতি তির্যকতা। নারী-পুরুষে এই বাইনারির প্রেম ক্রমশ বিস্বাদ, আবেগশূন্য, অর্থহীন অভ্যাস, রোমাঞ্চবিরহিত, জলে ভেজা পাউরুটি হবে, এই যুগলক্ষণ থেকে বিশ শতকের মহা মহা কবি-ঔপন্যাসিকদের আলাদা করে নেওয়া যাবে না কিছুতেই। এরই আরও এক বিশেষ প্রকাশ ‘মিসোজিনি’তে। ক্রমশ নারীর থেকে নাড়ি কেটে যাচ্ছে বিশ শতকের মননশীল সৃষ্টিশীলদের। “ভালবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে/ ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে” এই দ্বিত্ব, এই ‘পোলারাইজ়েশন’-এর পাকে পাকে, ‘অ্যাঞ্জেল হোর ডাইকোটমি’র উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরুর দোলাচলে থাকবে গোটা বিশ শতকের পুরুষ কলম।
টি এস এলিয়টের লেখায়, বিশেষত দি ওয়েস্ট ল্যান্ড ও ‘লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’-এ বার বার উঠে আসবে তাই, দুর্বলচিত্ত বা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত (বাংলায় বললে, স্নায়ুবিপর্যস্ত) মেয়েরা। এ নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে বিদেশি পড়ুয়াদের কলমে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেমিনারে টি এস এলিয়টের লেখার যুগলক্ষণ যত আলোচিত, ততটা না হলেও আলোচিত হয়েই চলেছে মেয়েদের উপস্থাপনার কথাগুলিও। রীতিমতো গবেষণা চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়।
লাভ সং বা প্রেমগান লিখতে কোনও যুগের কোনও কবিই পিছপা হননি, ছেদ পড়েনি প্রেম নিয়ে কবিতা বা গল্প-উপন্যাস লেখায়। কিন্তু পুরুষ কলমের সেই প্রেম সচরাচর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রেম বলেই হয়তো, বারে বারে নারী উপস্থাপিত হয়েছে সে সব লেখায়। আর সেখানেই আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। বারে বারে সমস্ত সাহিত্যেই যা, কচিবেলার গোগ্রাসে বই পড়ার দিনগুলি থেকেই যা বিস্মিত ও যুগপৎ বিমূঢ় করত তা হল, নারী কত বড় বিষয় লেখালিখির! কী আশ্চর্য, নারীশরীর, নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ, নারীকে নানা ভাবে উল্টেপাল্টে দেখার বীক্ষণ, এই পাঠের কোনও শেষ হয়নি আজও। এই গোটা যাত্রাটাই তাই আমাকে কৌতূহলী করে তত্ত্বের দিক থেকে দেখতে।
উপস্থাপনার ইতিহাস যদি দেখি, বিষয় হিসাবেই কিন্তু নারীকে দেখতে অভ্যস্ত আমরা। জনপ্রিয় সাহিত্য-শিল্পের কাছে সেটাই প্রশ্নচিহ্নহীন ধরে নেওয়া। এটাই পুরুষশাসিত সমাজের সহজ ছক। নারী পুরুষের প্রেরণা, আকাঙ্ক্ষার বিষয়, সম্ভোগের বস্তু, হাসিল করার পণ্য। সে একাধারে দেবী ও দানবী, অথবা হয় দেবী নয় দানবী।
“তাই আগে বুঝে নিতে চাই নারীর সেই প্রতিমা, পুরুষী কবিতার পরম্পরায় যা প্রতিফলিত। সে প্রতিমা পুরুষেরই কল্পনা... উর্বশী আর লক্ষ্মী, পুরুষী কবিতার পরম্পরায় নারীর এই দুই স্টিরিওটাইপই সবচেয়ে প্রবল, পশ্চিমী আলোচনার ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে অ্যাঞ্জেল হোর ডিকটমি।...পুরুষতন্ত্রের সেই পরম্পরার মধ্যে থেকেই মেয়েরা লেখেন।” (সুতপা ভট্টাচার্য, ‘কবিতায় নারী, নারীর কবিতা’, মেয়েলি পাঠ) দু’ভাবে বিষয় করা হয় নারীকে। হয় ‘ভয়্যারিস্টিক’ বিষয়— সে পুরুষচোখে নারী লালসাময় অপ্সরা। নতুবা ‘ফেটিশিস্টিক’ বিষয়, সে পুরুষচোখে নারী দেবী, ম্যাডোনা, মা। রিরংসা থেকে পবিত্রতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বেশ্যারও হৃদয়ে পথ আছে’ থেকে শঙ্খ ঘোষের ‘পায়ে শুধু পড়ে থাক স্তব্ধ এলোচুল’ অবধি।
ফিরে আসি জীবনানন্দে। তাঁর মানসকন্যা হিসাবে এক দিকে রয়েছে তাঁর বনলতারা। “কিশোরবেলায় যে কোনো এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে যে আমাদেরই আঙিনার নিকটবর্তিনী ছিল, বহুদিন যাকে হারিয়েছি-আজ, সেই কে যেন, পূর্ণ যৌবনে উত্তর আকাশে দিগঙ্গনা সেজে এসেছে। মিষ্টি ক্লান্ত অশ্রুমাখা চোখ, নগ্ন শীতল নিরাবরণ দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট,... সেই বনলতা— আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত সে।” (কারুবাসনা) অন্য দিকে আছে, সেই সব নিষ্ঠুরা স্ত্রীরা, মাল্যবান-এর উৎপলা যেমন। সেই সব দগ্ধ অসুখী দাম্পত্য। “নম্র বশ্য ঘরজোড়া স্নিগ্ধতা হল না, খড়খড়ে আগুন খড়ের চমৎকার অগ্নি-ডাইনির মত হল মাল্যবানের বিয়ে আর বৌ আর বিবাহিত জীবন।”
মাল্যবান জীবনানন্দের সর্বোত্তম উপন্যাস, বললে বাহুল্য হয় না। এই অত্যন্ত বিখ্যাত, বহুপঠিত উপন্যাস ধরে রেখেছে জীবনানন্দের নান্দনিক দর্শনের সারাৎসার, যা জীবনযাপনের সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই এত চমকপ্রদ। প্রেম ও শরীরী, বিপরীত লিঙ্গঘটিত সমস্ত সম্পর্কের নিষ্প্রাণতা ও শূন্যতা এ লেখার ছত্রে ছত্রে ঝাঁপায় পাঠকের উপরে। মাল্যবানের ‘আধুনিকতা’ তার দুর্ভর, ভয়াবহ ক্লিষ্ট যাপনের ভিতরে প্রতিফলিত। আধুনিক মানুষের এলিয়েনেশন, নিঃসঙ্গতা, নির্বান্ধব অবস্থা, তার ‘অ্যাংস্ট’, তার কারুবাসনা আর পদে পদে বিফলতার কথা লেখেন জীবনানন্দ এ উপন্যাসে। জে আলফ্রেড প্রুফ্রকের মতোই এই যুগসন্ধিক্ষণের বিশিষ্ট চেতনাবান মাল্যবান দাশগুপ্ত। আর ঠিক যতখানি যুগলক্ষণ ধরা আছে মাল্যবানের চিন্তাপ্রক্রিয়ায়, ততখানিই বিস্বাদ, বিবর্ণ, তিক্ত, ভয়াবহ তার বৈবাহিক জীবন। তার উপস্থাপনায়, উৎপলা নামের স্ত্রী ‘অদ্ভুত নিরেট নিগ্রহময়তা’ নিয়ে পাশাপাশি বসবাস করে। কারুবাসনা-র কল্যাণী আত্মসুখী, স্বার্থপর। ক্ষুদ্র মেয়ে বিছানা ভেজালে তাকে পাখার বাঁট দিয়ে মারে। ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ায় না। শুধু মাল্যবান-এর উৎপলা নয়। শুধু কারুবাসনা-র কল্যাণী নয়। অজস্র গল্পের অজস্র নারী, যারা মূল চরিত্রের স্ত্রী, তারা আত্মসুখী, শরীরসুখসর্বস্ব, স্বামীর প্রতি ‘কর্তব্যকর্ম’-এ অমনোযোগী, অপ্রেমী। স্বামী যেখানে বিয়ের পর পর বিছানা ছেড়ে অতি ভোরে উঠে বেড়াতে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়, কেননা স্ত্রীসঙ্গ তার কাছে বিকর্ষণ বা বিবমিষার। এই অসুখী দাম্পত্য-সম্বাদ প্রায় সব কাহিনিতেই।
সংস্কৃতিতে স্থূল-সূক্ষ্মের বিবাদ অবশ্যই আছে। আধুনিক কারুবাসনাকামী মানুষের দোলাচল এই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই স্ববিরোধ, এই আমূল বিপরীতগামী দু’টি স্রোতের মন্দ যা কিছু, তার সবচেয়ে বড় ও বিশদ উদাহরণ হয়ে থাকে স্ত্রীজাতি। যেখানে উৎপলা বিবৃত হয় গাঢ় তুলির টানে, অত্যন্ত কঠোর কালিমায়। এই কালিমা কতখানি বাস্তবজীবন আহরিত, আর কতখানি কল্পনার? এই টেমপ্লেট ধরেই এর পরে অন্য আধুনিকেরা রচনা করবেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস। একই ছকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বা সমরেশ বসুদের আধুনিকতাও নির্মিত হবে। অস্তিত্ববাদী দর্শনের সারাৎসার রচিত হবে নারীর শরীরের উপর আক্রোশ থেকে। যেমন সমরেশ বসুর বিবর-এ নীতাকে সঙ্গমের পর গলা টিপে খুন করা হয়ে ওঠে ভবিতব্য, নিছক অর্থহীনতাবোধ থেকে। প্রেম প্রণয় ও কামের বস্তু থেকে নারীশরীর কত সহজেই হয়ে উঠতে পারে ঘৃণা ও বিবমিষার বস্তু। অন্য দিকে সন্দীপনের আঁকা স্ত্রীরা প্রায়ই বীভৎস নিষ্ঠুর ও কদর্য।
কবিতাতেও এ জিনিস ঘটে চলে। শামশের আনোয়ারের কবিতায় যেমন: “নিষ্ঠুর পিঠ যেন খোলা মাঠ।” “তুমিই আত্মীয়, বুক, শাবল ও কঠিন আঁধার,” এক নারীর উদ্দেশে তীব্র কাতরতার সঙ্গে উত্থিত হয় ঘৃণা, কিমিতিবোধ। “মূর্খতার গুঁড়ো মেখে নিই প্রত্যেক সন্ধ্যায়/ তোমাদের মুখ হতে মূর্খতার গুঁড়ো চেটে খাই।” শীতল এক মেয়ের ছবি ফুটে ওঠে। এলিয়টের দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক মনে পড়ে, “ইন দ্য রুম দি উইমেন কাম অ্যান্ড গো/ টকিং অব মিকেলাঞ্জেলো।” নারীর ভয়াবহতা বার বার আসে শামশেরের কবিতায়: হিংস্রতায় কাঁটা চামচের মতো জ্বলে ওঠা বান্ধবীর মুখ, “শ্যাম্পেনের মতো উগ্র হাসির হাতছানি/ পিয়ানোর সামনে বসে থাকা বাঘিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়।” অসামান্য কবিতা, কিন্তু প্রতিপক্ষ ছাড়া নারী অন্য কোনও ভাবেই নেই। নতুন দৃশ্যকল্প ও চিত্রকল্প দিয়ে এক আধুনিক, সামাজিক, শহুরে ও শীতল মেয়েকে আঁকেন কবি, যা ভয়াবহ ও আক্রামক।
সুনীলের নীরা সিরিজ়ের মুগ্ধতা (“বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে৷/ তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের নীল দুঃসময়ে।”) আর জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’-এর ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ অনেক বেশি আলোচিত ও উদ্যাপিত। তার উল্টো পিঠে, মেয়েদের উপস্থাপনার এই জটিল ও ভয়াবহ সম্ভাবনাগুলিকে আরও খুঁটিয়ে দেখা জরুরি। না, ‘ক্যানসেল কালচার’-এর আতশকাচ দিয়ে বহুমূল্য সাহিত্যকে ছুড়ে ফেলতে নয়, প্রবণতা চিহ্নিত করতে।
আধুনিক সাহিত্যের যুগলক্ষণ বিগত হলেও, জনপ্রিয় সাহিত্য, সিনেমা, সংস্কৃতিতে যে-হেতু নারীঘৃণা ক্রমশ, আরও বেশি লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy