E-Paper

লড়াই, তবে একক মানুষের

বৈচিত্রই তপন সিংহের প্রতিশব্দ। তিনি রবীন্দ্রনাথেও আছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েও। শরদিন্দুতে, আবার শংকরেও। বনফুলে যেমন, গৌরকিশোরেও। আবার খবরকাগজের রিপোর্টিং থেকেও তুলে নিচ্ছেন ছবির বিষয়।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪৮
Share
Save

কেন মনে রাখব তপন সিংহকে, কেন দেখব আজও ওঁর ছবি? ২ অক্টোবর তিনি শতবর্ষ পূর্ণ করলেন, ফুল-মালা-ফেসবুকে এক প্রকার পোশাকি ও প্রথানুগ শ্রদ্ধার্পণের পর ফুরসত পেলে যদি এই প্রশ্নগুলো করা যায়, নিজেরাই তার সদুত্তর দিতে পারব কি? পাঁচ দশকব্যাপী দীর্ঘ ছবিজীবনে ছোট-বড় মিলিয়ে এতগুলো ছবি বানিয়েছেন তিনি যে, তাঁর ফিল্মোগ্রাফি মনে রাখাটাই শক্ত। তবু তপন সিংহ বলতেই আজকের বাঙালির মুখ থেকে কয়েকটা ছবির নাম অনায়াসে বেরোবে: কাবুলিওয়ালা, গল্প হলেও সত্যি, জতুগৃহ, নির্জন সৈকতে, ঝিন্দের বন্দী, বাঞ্ছারামের বাগান। কিংবা যে ছবির সংলাপ আজকের ভাষায় ‘কাল্ট’— ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’— আতঙ্ক। আর একটু চেপে ধরলে হয়তো মনে পড়ে যাবে, ও হ্যাঁ, তপন সিংহ মানে তো ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, হাটে বাজারে, সাগিনা মাহাতো-ও। পাশ থেকে কেউ মনে করিয়ে দিতে পারে: এখনই, বা হুইলচেয়ার-এর কথা বলবেন না? বা, ওঁর করা ছোটদের চিরসবুজ ছবিগুলো?

বৈচিত্রই তপন সিংহের প্রতিশব্দ। তিনি রবীন্দ্রনাথেও আছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েও। শরদিন্দুতে, আবার শংকরেও। বনফুলে যেমন, গৌরকিশোরেও। আবার খবরকাগজের রিপোর্টিং থেকেও তুলে নিচ্ছেন ছবির বিষয়। ‘বোরিং’ হতে চাননি কখনও, একটা ছবি করে উঠেই পরের ছবি এমন এক স্থান-কাল-পাত্রপাত্রীতে এনে ফেলেছেন যে দেখে বিস্ময় জাগে: ঝিন্দের বন্দি-র পরের ছবি কি না হাঁসুলি বাঁকের উপকথা! কাকে নিয়ে না কাজ করেছেন: উত্তমকুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অশোককুমার, দিলীপকুমার, সায়রা বানু, বৈজয়ন্তীমালা, মাধবী মুখোপাধ্যায়, রুমা গুহঠাকুরতা, শর্মিলা ঠাকুর, তনুজা, অপর্ণা সেন, শাবানা আজমি— অরুন্ধতী দেবী তো বটেই। নির্মলকুমার তাঁর ছবিতে প্রায়-অচ্ছেদ্য, মঞ্চ থেকে নিয়ে এসে বাংলা সিনেমাকে উপহার দিচ্ছেন অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদ থেকে মনোজ মিত্রকে, জাত চিনিয়ে দিচ্ছেন স্বরূপ দত্ত বা শমিত ভঞ্জের; ছবি বিশ্বাস বা ছায়া দেবীকে হাতে ধরে বসিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বস্তরের চলচ্চিত্রাভিনয়ের তখ্‌তে। স্রেফ ‘চিত্রপরিচালক’ নন, তপন সিংহ আদ্যন্ত ‘চলচ্চিত্রকার’, ‘ফিল্মমেকার’। ছবির বিষয় বাছা থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য, কাস্টিং, সঙ্গীত, অভিনয়, শুটিং, পোস্ট-প্রোডাকশন থেকে ছবির মুক্তি অবধি (এবং তার পরেও) যে একটা দীর্ঘ যাত্রা, সেই ‘জার্নি’টা তিনি বার পঞ্চাশেক হেঁটেছেন একা এবং সবাইকে নিয়ে, প্রতি বারই বুঝিয়ে ছেড়েছেন চলচ্চিত্র কী বস্তু, কোথায় তার রস, কেন সে শিল্প।

তা সত্ত্বেও, চলচ্চিত্র-সমালোচনার একটা গোটা পর্ব জুড়ে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিকের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে তাঁর নাম নিতে বাঙালির কী এক সংশয় কাজ করে গেল। তাঁর বহু ছবি ব্যাপক ভাবে ব্যবসাসফল, একটা ছবি শেষ হতে না হতেই প্রযোজকেরা তাঁর কাছে ছবি করার আবদার এবং অফার নিয়ে আসতেন, তবু তাঁর ছবিকে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি বলা যাচ্ছে না, আবার পুরোদস্তুর আর্ট ফিল্মও না— এই আজব দোটানায় পড়ে তৈরি করা হল ‘মিডল অব দ্য রোড মুভি’র মতো বকচ্ছপ শব্দবন্ধ। সবচেয়ে মজার কথা— যাঁকে নিয়ে, যাঁর ছবি নিয়ে এত কিছু, সেই তপন সিংহ এ সব পাত্তাই দিলেন না আজীবন। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির নির্বোধ সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন চাঁছাছোলা ভাষায়। মৃণাল সেনের ছবির অন্তর্ঘাতই ছিল তাঁর জবাব, ঋত্বিকের বোহেমিয়ানা যে কোনও উপরচালাকিতে ঝামা ঘষে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এঁদের পাশে তপন সিংহ ছিলেন নির্ভার ও নির্বিকার; কাজের সময় গলার আওয়াজ কখনও বাড়ত না এক কাঠি, অথচ যা বলার এবং করার তা ঠিক হয়ে যেত। ফিল্মমেকারের ব্যক্তিত্বের কোন মোহে পড়া যায় তার অপেক্ষায় বাঙালি হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, তপন সিংহের ক্ষেত্রে এই ‘ট্রু জেন্টলম্যানশিপ’টি চোখ চেয়ে দেখার তো বটেই, শেখারও।

তাঁর “দু’টি হাতের একটি হয়তো সব সময় কোয়ালিটির সন্ধান করে বেড়াত আর অপর হাতটি ধরা থাকত জনসাধারণের হাতের সঙ্গে,” তরুণ মজুমদার লিখে গেছেন এ কথা, তপন সিংহ সম্পর্কে। তপন সিংহের এর চেয়ে সুপ্রযুক্ত মূল্যায়ন আর দু’টি নেই। তাঁর ছবি সম্পর্কে এমন অভিযোগ ওঠে যে তা এক রকম ‘সুইটনেস’-এ ভরা, শ্রেণি বা সমষ্টির সংগ্রাম সেখানে নেই, ব্যক্তি মানুষের লড়াই আছে কিন্তু সেও উচ্চকিত বা চিৎকৃত নয়, সবটাই খুব আদর্শবাদী— বাস্তবে ও রকম হয় নাকি? তাঁর ক্ষণিকের অতিথি, হাটে বাজারে বা হুইলচেয়ার-এর ডাক্তার চরিত্রগুলি দেবদূতসম, আদালত ও একটি মেয়ে-র পুলিশ চরিত্রটি ভালমানুষির পরাকাষ্ঠা, এমনকি কালো চরিত্রগুলোর মধ্যেও আসলে বসবাস প্রকৃত ভালর, আদমি অউর অওরত-এ যেমন। কবিকে জীবনচরিতে খুঁজতে নেই হয়তো, কিন্তু তপন সিংহের জীবন খুঁড়লে এক দিকে বেরিয়ে আসবেন রবীন্দ্রনাথ, অন্য দিকে বাঙালির আবহমান মূল্যবোধগুলির আভিজাত্যে স্নাত এক ধরনের আদর্শবাদ। একক ব্যক্তি-চরিত্রের মধ্য দিয়েই তা পর্দায় ফুটে ওঠে বলে মনে হয় যেন চরিত্রগুলি এই ধূলিমলিন সমাজের নয়, এরা যা পেতে বা করতে চাইছে তা অন্য এক বিশ্বে সম্ভব। তপন সিংহের ছবির সম-আলোচনা যদি করতেই হয়, তার সূত্রটি এই জায়গা থেকে শুরু হতে পারে, হওয়া দরকারও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tapan Sinha Bengali Films

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।