লড়াই: মাধবী পুরী বুচের পদত্যাগের দাবিতে ইডি-র দফতরের সামনে তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডির ধর্না। ২২ অগস্ট, হায়দরাবাদ। ছবি: পিটিআই।
দু’টি সাম্প্রতিক ঘটনা, দু’টিই বহুচর্চিত, অবশ্য বিভিন্ন আঙিনায়। প্রথমটি কলকাতার আর জি কর হত্যা, যা দেশে বিদেশে ভূমিকম্পের মতো সাড়া জাগিয়েছে— নাগরিক পরিসরেসংঘটিত ভয়াবহ নৃশংসতার জন্য। দ্বিতীয় ঘটনাস্থল মুম্বই। ভারতের মূলধনি বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিয়োরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি)-র চেয়ারপার্সন মাধবী পুরী বুচের বিরুদ্ধে এক বিস্ফোরক অভিযোগ করেছে আমেরিকান লগ্নিসংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ— সংস্থাটির দাবি, আদানি গ্রুপ ব্যবহার করত, এমন অফশোর ফান্ডে মাধবী ও তাঁর স্বামী ধবল বুচেরও লগ্নি ছিল।
অভিযোগটিকে দেখতে হবে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই সংস্থারই আনা গত বছরের অভিযোগের ভিত্তিতে। গত বছর জানুয়ারি মাসে সংস্থাটি নথিপ্রমাণ সমেত দাবি করেছিল, আদানি গোষ্ঠীর প্রধানের বিদেশে প্রচুর আর্থিক লেনদেন আছে— তাঁর সাইপ্রাস-প্রবাসী দাদা বিনোদ আদানির অদৃশ্য হাতের খেলায় সেই অর্থ ভান্ডারই বিদেশি লগ্নি হিসাবে দেশে হাজির করেন আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ার হিসাবে। ফলে বাড়তে থাকে গোষ্ঠীর শেয়ার মূল্য। ফলস্বরূপ, ঋণ চাইতে আর আদানি গোষ্ঠীকে ব্যাঙ্কের দরজা নাড়তে হয় না, ব্যাঙ্কই সিন্দুক নিয়ে হাজির হয় তার দ্বারপ্রান্তে। এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত আর্থিক বছরের শেষে আদানি গোষ্ঠীর মোট দেনা ছিল ২,৪১,৩৯৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে দেশি ঋণদাতারা জুগিয়েছেন ৮৮,০০০ কোটি। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ অভিযোগ করেছিল, এ ভাবেই আদানি গোষ্ঠী শেয়ার বাজারকে নিজের স্বার্থে চালিত করছে। ব্যাপারটি সুপ্রিম কোর্টের গোচরে আনার পর আদেশ হয়, সেবি তদন্ত করুক।
তার পর গড়িয়ে যায় মাসের পর মাস, কিন্তু তদন্ত এগোয় না তেমন। এই প্রেক্ষাপটেই এল নতুন অভিযোগ যে, স্বয়ং সেবি-র চেয়ারপার্সনই নাকি সাত বছর আগে সেবিতে ডিরেক্টর হয়ে যোগ দেওয়া পর্যন্ত লগ্নি করতেন বিনোদ আদানির ফান্ডে, এবং তারই সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভারতে অবস্থিত তহবিলের মালিক মাধবীর স্বামী ধবল বুচ। সেই মাধবী পুরী বুচই করেছিলেন আদানি সম্পর্কে ‘অনুসন্ধান’। সচরাচর সেবি-র প্রধান নিযুক্ত হন আইএএস অফিসাররা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিয়োগ কমিটি দ্বারা বাছাইয়ের পর। মাধবীকে এই পদে নিয়োগের পিছনে কারও হাত ছিল কি না, স্বভাবতই সে প্রশ্নটি উঠছে।
দেশে এখন শেয়ার বাজারে (মিউচুয়াল ফান্ড-সহ) অর্থ গচ্ছিত রাখবার জন্য প্রয়োজনীয় ‘ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট’-এর সংখ্যা ১৬ কোটির উপর। কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে হিন্ডেনবার্গ-এর ‘বোমা’য় তেমন হইচই হল না দেশ জুড়ে। প্রায় মাস ঘুরতে চলেছে এই কাণ্ডের পর। অথচ এখনও মাধবী সমাসীন তাঁর আসনে। এবং নির্লিপ্ত অর্থমন্ত্রী, নির্লিপ্ত ইডি, সিবিআই। এবং সবচেয়ে অবাক কথা— নির্লিপ্ত বাজারও। অথচ কী বিপুল গণপ্রতিবাদ শুরু হল অভয়ার হত্যার পর। অসংখ্য মানুষ তুললেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনি! কিসের প্রতিকারের জন্য জাস্টিস? শুধু এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে? না কি অন্য কোনও কারণও আছে?
অন্য কারণ অবশ্যই আছে। তা হল, এক মেডিক্যাল ছাত্রীর হত্যার মাধ্যমে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ-তরুণীদের এক মসৃণ জীবনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়া। দেশে কোথাও চাকরি নেই। গবেষণা সংস্থা সিএমআইই-র জুন মাসের সমীক্ষা অনুযায়ী বেকারের অনুপাত ছিল ৯ শতাংশের বেশি; অবশ্য অনথিভুক্ত কর্মহীনের অনুপাত তার চেয়ে অনেক বেশি। বিচারের দাবিতে পথে-নামা মিছিলের মুখগুলি বলে দেয় যে, টি-শার্ট পরিহিত এই মধ্যবিত্ত সন্তানরা কয়েক দশক আগে হয়তো থমকে ছিল মধ্যবিত্তেরও নীচে। আগে এদের আকাঙ্ক্ষার সীমা ছিল বড় জোর গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি। পরে এল এঞ্জিনিয়ারিং-এর হাওয়া। তারও পর বেঙ্গালুরু ও আইটি। কিন্তু চাকরি কোথাও নেই। এ বছর পাশ করা ১৫ লক্ষ এঞ্জিনিয়ারিং স্নাতকদের ১০ শতাংশেরও কম নাকি ক্যাম্পাস থেকে চাকরি পেয়েছে। ভারতে শিল্পবিপ্লব হয়নি, পাল্টেছে প্রযুক্তি, এসেছে কৃত্রিম মেধা নিয়ে ভীতি, কমেছে বেঙ্গালুরুর টান, ফিকে হয়েছে সিলিকন ভ্যালির স্বপ্ন। এই অবস্থায় ভবিষ্যতে স্বাচ্ছল্য ও স্বনির্ভরতার একমাত্র গ্যারান্টি ওই চিকিৎসকের সাদা এপ্রনটি।
আপাতত সবাই মনে করছেন, অভয়ার হত্যাকে ধামাচাপা দিতে অধীর আগ্রহী যুগপৎ কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকার। পুলিশের রিপোর্ট গ্রহণে দেরি, মৃতার মা-বাবাকে এটি আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানো, সাত তাড়াতাড়ি অকুস্থলের কাছে কোনও অছিলায় দেওয়াল ভাঙা যার ফলে প্রমাণ লোপাট হতে পারে, পোস্ট-মর্টেমে অসংখ্য প্রশ্নচিহ্ন, মৃতদেহের দ্রুত দাহকার্য, কলেজের বিতর্কিত অধ্যক্ষকে আড়াল করতে রাজ্য সরকারের হিমশিম চেষ্টা— সবের মধ্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত, এক ক্ষমতাশালী অশুভ চক্র শশব্যস্ত সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ গোপন করতে। তার পর হাই কোর্টের হস্তক্ষেপে সিবিআইয়ের তদন্তে অবতরণ। এবং তারই মাঝে ‘ছাত্র সমাজ’-এর ডাকা মিছিল, পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে যারা শামিল।
আর জি করের অভয়াকে কে বা কারা কেন হত্যা করেছিল তা তদন্তের বিষয়, এবং তদন্তের ক্ষেত্রে সিবিআই যে শেষ কথা, তাও ঠিক নয়। না হলে কেন আজও নিষ্পত্তি হল না চিট ফান্ড সংক্রান্ত মামলার? কিংবা হাথরস ধর্ষণ-কাণ্ডের? তবে আর জি করের ঘটনাটির রাজনীতিকরণ এখন সম্পূর্ণ। মাঝখানে পুলিশকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করছে এক যুবসম্প্রদায়, যারা সকলেই মধ্যবিত্ত হলেও বিভিন্ন জাত ও ধর্মের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের সাবর্ণ অনুপাত কম (১০%), এবং উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ বামফ্রন্ট আমল থেকে প্রসারিত হওয়ার দরুন মধ্যবিত্ত বৃত্তটি এখন আর শুধু ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেটিই এনেছে আন্দোলনের লড়াকু চেহারা। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি এই আন্দোলনকে মদত দিয়েছে ঘোলা জলে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি উত্তপ্ত অন্য ভয়ে— ডাক্তার হয়ে উপার্জনের একমাত্র সম্ভাবনাটিতে কুঠার আঘাত হানছে এই দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার। ফোনে ফোনে ঘুরছে অভিযোগ যে, এমডি উত্তীর্ণ হতে ২০-২৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
শেয়ার বাজারে আদানির কর্তৃত্ব, এবং তার ফলে লগ্নির বহু লক্ষ কোটি টাকা উবে যাওয়ার ভয়— এ সব হল এক অন্য গোত্রের আশঙ্কা, যাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্তেজনার কোনও কারণ নেই। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়। ভারতের অর্থনীতি মোটেই পশ্চিমি দেশের মতো বাজারমুখো নয়, যদিও সরকার যে ধারণা সৃষ্টি করতে চায় তা হল, ভারতের সবাই এখন ‘স্মার্ট ইনভেস্টর’ যারা বালিশের নীচে টাকা রাখে না, রাখে একুইটি ফান্ডে। কিন্তু সত্য আসলে অন্য রকম। শেয়ার বাজারে অ্যাকাউন্টের সংখ্যা অনেক হলেও একটি সমীক্ষা অনুসারে তাদের মোট লগ্নির ৬৮ শতাংশ পোর্টফোলিয়ো মাত্র এক লক্ষ টাকা বা তারও কম। উপরের আরও ২১ শতাংশের লগ্নির পরিমাণ এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষের মধ্যে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের শেয়ারে গচ্ছিত বিত্তের পরিমাণ অতি নগণ্য। এ ক্ষেত্রে তারা আদার ব্যাপারি। এ দিকে যারা জাহাজের খবর রাখে তারা জানে, মাধবী বুচের কার্যকলাপ যতই অনৈতিক মনে হোক, তা ‘প্রাইসড ইন’ হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ বাজারে শেয়ারের মূল্যে তা ইতিমধ্যে প্রতিফলিত।
ভারতের বড় শহর, ছোট শহর, মফস্সল— সর্বত্রই মধ্যবিত্ত তরুণদের জীবনে যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, ছোট হচ্ছে— তা হল স্বপ্নের পরিধি। ক্রীড়াজগতের পথের বাঁকে বাঁকে রাজনীতির চেকপোস্ট— আইসিসি প্রধান অমিত শাহের পুত্র, ভারতের ক্রিকেট বোর্ড প্রধান প্রয়াত অরুণ জেটলি-তনয় রোহন। ও-দিকে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময়-মূল্য কমতে কমতে বিদেশে পড়তে যাওয়াও কষ্টসাধ্য, পঞ্জাবে দেওয়ালের উপর ‘কানাডা চলো’ লিখনও কমে আসছে। দেশের সর্বত্র তরুণ সমাজ কলকাতার মতো তাদের বিরক্তি রাস্তায় প্রদর্শন করে না, করে ভোটের মেশিনে। সেই জন্যই এ বার কমলবনে ‘চারশো পার’ না হয়ে ফুটল মাত্র ২৪০টি ফুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy