মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর আসন পাতা রয়েছে। এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে আহ্বান রয়েছে। ভোট কিনতে বাংলার মা-বোনেদের জন্য ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ রয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীই নেই বাংলায়। চঞ্চলা লক্ষ্মী বাংলার আসন ছেড়ে কেন চলে যান অন্য ঘরে? অন্য রাজ্যে? এ প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে। কারণ, যে রাজ্য নিজেই ভাঁড়ে মা ভবানী, সে কোন মন্ত্রে ধরে রাখবে ঘরের লক্ষ্মীকে? যে রাজ্যে ‘বাণিজ্যে বসতে রাজনীতি’ সেখানে লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান হবে কী করে?
বাংলায় লক্ষ্মী সত্যিই চঞ্চলা! ভক্তিই শুধু অচলা। সেই সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে-আসার লোকদেখানো ভড়ং। আদৌ সমৃদ্ধির ছাপ নেই রাজ্যে। ভোট কেনার ভর্তুকি-সর্বস্ব বাংলার অর্থনৈতিক হাল ঠিক কেমন, তা উঠে এসেছে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি’ (এনআইপিএফপি) প্রকাশিত রিপোর্টে। বিভিন্ন রাজ্যের ভর্তুকির বহর খতিয়ে দেখে এনআইপিএফপি ওই রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্নেহের পরশ, গতিধারা, মুক্তিধারা, জলধারা সবই চলে ধারের টাকায়। এমনকি, দুর্গাপুজোর জন্য হাজার হাজার ক্লাবকে বিলি করা টাকাও আসলে ঋণ করে নাম কেনা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজকোষের সামগ্রিক হাল নিয়েও এনআইপিএফপি-র রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, নিজস্ব আয়ের মাপকাঠিতে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচেষ্টায় অনেক ঘাটতি। রাজ্যের নিজস্ব আয় রাজ্যের জিডিপি-র ৫ শতাংশেরও কম এবং তা দিন দিন কমছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, ঋণের সুদ মেটাতেই চলে যায় বেশির ভাগ টাকা। ন্যায্য মহার্ঘ ভাতাও দেওয়া যায় না।
আসলে হবে না কেন? তৃণমূল নামক দলটির কোনও অর্থনৈতিক আদর্শ বা নীতিই তো নেই। শুধু খাও, খাও আর খাও। একটি রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির অন্যতম সূচক হল স্টার্ট আপ। কত নতুন সংস্থার জন্ম হচ্ছে। হিসাব বলছে, কর্নাটকে ১৫,০১৯টি স্টার্ট আপ রয়েছে। দিল্লিতে ১৪,৭৩৪টি, উত্তরপ্রদেশে ১৩,২২৯টি। ১১,৪৩৬টি স্টার্ট আপ নিয়ে গুজরাত পঞ্চম স্থানে। এর পরে তামিলনাড়ুতে ৯,২৩৮, হরিয়ানায় ৭,৩৮৫টি। নতুন রাজ্য তেলঙ্গানায় ৭,৩৩৬টি। আর পশ্চিমবঙ্গে তার চেয়েও কম ৪,৬২৭টি। এমনকি কেরালাতেও বাংলার চেয়ে বেশি— ৫,৭৮২টি। এমন হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল, বাংলার সরকারের কোনও নির্দিষ্ট স্টার্ট আপ নীতিই নেই।
কোনও কিছু হলেই বাংলার সরকারি মুখপাত্রেরা অন্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করেন। সেটা দিয়েই বোঝা যায় বাংলার স্থান কোথায়। কিন্তু বাংলা তো এমন ছিল না! দেশের শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদনের কথা বলতে গিয়ে ১৯৪৭ সালে অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, দেশের মোট উৎপাদনের ২৪ শতাংশ আসে বাংলা থেকে। আর স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে বাংলার ভাগ কমতে কমতে লজ্জাজনক ৩.৫ শতাংশ। সেমিকন্ডাক্টার ক্ষেত্রের শিল্প সংস্থাগুলি অসমে চলে যাচ্ছে কিন্তু বাংলায় বিনিয়োগে রাজি নয়।
বেকারত্ব বাংলার বড় সমস্যা। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় শিল্পোদ্যোগের পথে না-হেঁটে সরকার যুবকদের খেলা-মেলায় মজিয়ে রেখেছে। আবগারি থেকে আয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অর্থকরী এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রয়োজনে বিনিয়োগ আনায় মন নেই। ইলেকট্রনিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রেও কোনও উদ্যোগ নেই। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাড়ু যে হারে এগোচ্ছে, একই হারে পিছিয়ে চলেছে বাংলা। অথচ উৎপাদন ক্ষেত্রের শিল্প অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ায় নতুন যুগের অন্যান্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ইলেকট্রনিক বা অটোমোবাইলের মতো কোনও বড় শিল্প বাংলায় এসেছে বলে দেখা যায়নি গত এক দশকে। একটিরও উদ্বোধন হয়নি।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, গোটা দেশে বাঙালি ইঞ্জিনিয়রদের অনেক সুনাম। তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও দেশের সব রাজ্যে বাঙালির রমরমা কিন্তু বাংলায় কাজ নেই। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ, নিউটাউনের আশপাশের এলাকা ছাড়া রাজ্যের আর কোথাও তথ্য ও প্রযুক্তি শিল্পের ছোঁয়া নেই। কর্নাটক, হরিয়ানার মতো রাজ্যও যেখানে এগিয়ে গিয়েছে সেখানে বাংলায় এখনও তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কোনও সার্থক উদ্যোগ নেই। যেটুকু রয়েছে তা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় একেবারেই নগন্য। একটা সময় পর্যন্ত কলকাতা ও শিলিগুড়ি শহর বাণিজ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু এখন দুই শহরই যেন ব্যবসার বৃদ্ধাশ্রম হয়ে গিয়েছে।
রাজ্যের শিল্পের কোনও পরিবেশ গড়ে না ওঠায় দেশের শিল্পপতিরাই আর ভরসা করেন না। রাজ্য বছর বছর বাণিজ্য সম্মেলন করে, মুখ্যমন্ত্রী বিদেশে যান শিল্প আনতে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি গত এক দশকে। আর বিদেশি বিনিয়োগও নেই বললেই চলে। মাথাপিছু প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্র হিসাবেও অনেক অনেক পিছিয়ে বাংলা। দেশের সাত শতাংশ জনসংখ্যা বাংলায়। অথচ রেডিটের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলায় মাথাপিছু এফডিআই মাত্র ০.৭৫ শতাংশ।
পরিষেবা ক্ষেত্রেও বাংলার স্থান নেই প্রথম সারিতে। দেশের বাকি রাজ্য এগিয়ে গেলেও বাংলা জগদ্দল পাথরের মতো একই জায়গায়। ফলে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। এই ক্ষেত্রেও বাংলার ছেলেমেয়েরা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু বাংলায় নিম্নস্তরের বিনিয়োগ আসছে পরিষেবা ক্ষেত্রে। ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভাল বেতন মেলে না। আর তাতেই বাংলার যোগ্য, দক্ষ কর্মীরা অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। মেধা ধরে রাখার সামর্থ্য নেই বাংলার সরকারের। এই সবের আড়ালে একটাই কারণ, রাজ্যের সরকারের উন্নয়নমুখী কোনও নীতি নেই। বামশাসনে যে অবক্ষয় শুরু হয়েছিল, যোগ্য উত্তরসুরির মতো সেটাই বহন করে চলেছে তৃণমূল শাসিত সরকার। এর উপরে রয়েছে সব ক্ষেত্রে পাহাড় পরিমাণ দুর্নীতি। তাতে অবশ্য বেশ ‘সুনাম’ অর্জন করেছে পশ্চিমবঙ্গ। আর তাতেই বাংলার নাম শুনলে কপাল কুঁচকে অন্য রাজ্যের দিকে তাকান শিল্পপতিরা। আর বাংলার আসন ছেড়ে চঞ্চলা লক্ষ্মী চলে যান অন্য ঘরে। অন্য রাজ্যে। সরকার ভুলে গিয়েছে যে, আয়-ব্যয়ের ফারাক বা ঘাটতি এবং দেনার বহর কমাতে গিয়ে পরিকাঠামোর পিছনে খরচ কাটছাঁট করতে নেই। কারণ, পরিকাঠামো খাতে খরচ করলেই অর্থনীতির গতি বাড়ে।
আমরা কোথায় ছিলাম সে স্মৃতি নেই। ভবিষ্যতে কোথায় যেতে চাই তার দিশা নেই। এক নৈরাজ্যে বাস আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy