সরকারের নানা সমস্যা থাকে। সরকারকে সব দিক দেখতে হয়। প্রজাপালন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন, দুর্বলকে সহায়তা ও সুরক্ষা দান, এ সবই সরকারের কাজ। কাজেই সরকার যখন বলে, সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সব কাজ সময়মতো করে উঠতে পারছি না, বোঝা যায়। অন্তত কিছুটা।
কিন্তু বিচারবিভাগ? তার কাজ, আইন আছে কি না, আইন মানা হচ্ছে কি না দেখা। বিচারনীতির সাহায্যে বিচার্য বিষয়ের নিষ্পত্তি করা। নীতি পালন হল কি না নিশ্চিত করা, যাতে যে বঞ্চিত সে যেন সুরাহা পায়। তবে মাননীয় বিচারবিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রেখেও বলতে হয় যে, সামাজিক দাবি, সংঘর্ষ, অথবা বিবাদের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের অসুবিধা অনেক। ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিবাদের নিষ্পত্তিতে অভ্যস্ত বিচারালয় অনেক সময় কিছু প্রশ্নের সামনে ‘পাত্রাধার তৈল, নাকি তৈলাধার পাত্র’ কেন্দ্রিক ভাবনায় নিমজ্জিত হয়।
প্রশ্নগুলো সহজ নয়। সামাজিক ন্যায়ের সংজ্ঞা কী? কী ভাবে সামাজিক ন্যায় নিয়ে দাবির নিষ্পত্তি হবে? কী ভাবে প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক ও সামাজিক বোধ বিচারবিভাগীয় যুক্তির অঙ্গ হবে, তার মূল প্রেরণা হয়ে উঠবে? আসলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে সমাজে পুনঃপ্রোথিত করা। সমাজবহির্ভূত যুক্তিবিন্যাসের নিয়ন্ত্রণ থেকে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিকে মুক্ত করা।
দেশ জুড়ে বিভিন্ন বিচারালয় এবং উচ্চতম আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিচারবিভাগের দুশ্চিন্তা মানুষের পেশাদারি জ্ঞান ও ক্ষমতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে; সামাজিক পশ্চাৎপদতা নিয়ে নয়। সামাজিক পশ্চাৎপদতার ধারণায় প্রচ্ছন্ন যে, হিন্দুসমাজেই পশ্চাৎপদতা আছে জাতিপ্রথার ফলে, অন্যান্য ধর্মের সমাজে নেই। আদালতে তাই কখনও-কখনও সংরক্ষণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের সরকারি চেষ্টাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। পাটীদার, গুজ্জর, মরাঠা, জাঠ— এই সব সম্প্রদায় অনুন্নত বলে স্বীকৃত হতে পারে, অথবা, অন্তত তাদের দাবির ভিত্তি আছে বলে গণ্য হতে পারে। কিন্তু মুসলমান সমাজের পশ্চাৎপদ অংশের মানুষের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রসারিত হলে বিচারবিভাগের সন্দেহ আর সমস্যা মাথা চাড়া দেয়।
সামাজিক ও আর্থনীতিক পশ্চাৎপদতা কাটানোর উদ্যোগের বিচারের ক্ষেত্রে কখনও যুক্তি দেওয়া হয়— তেলা মাথায় তেল দেওয়া হচ্ছে। কখনও বলা হয়, কর্মে পারদর্শিতা খর্ব হচ্ছে। কখনও আদেশ হয়েছে, পঞ্চাশ শতাংশের বেশি যেন সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকে। আমরা পিছিয়ে আছি বা যাচ্ছি, কারণ, আমরা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। এই সব যুক্তি বোঝা শক্ত। সামাজিক পশ্চাৎপদতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে মনোযোগ দিতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইতিহাস ও সামাজিক বোধ— আইনকেন্দ্রিক বিচারবোধের স্থান তার পরে। ফলত, কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে যে কিছু পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাতিল হল এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পশ্চাৎপদ কমিশনের কিছু প্রস্তাব ও উপদেশও নাকচ হল, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিচারবিভাগীয় যুক্তি ও পদ্ধতির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়ের প্রসার
ঘটবে, এ আশা দুরূহ।
বামপন্থীরা কেন এ নিয়ে নীরব জানি না। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলেই বেশ কিছু সম্প্রদায়কে ‘অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার মধ্যে ৩৪টি ছিল মুসলিম গোষ্ঠী। ২০১২ সালে তৃণমূল সরকার ৭৭টি গোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদ এবং অধিক পশ্চাৎপদ বলে চিহ্নিত করে। এই ব্যবস্থাকে নাকচ করার ক্ষেত্রে বিচারবিভাগ যে যুক্তি দিয়েছে, তা হল, পশ্চাৎপদ কমিশনের মাধ্যমে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত না করে সরকারি আদেশ দিয়ে সংরক্ষণ সম্প্রসারণ করে সরকার ভুল করেছে। অথচ, ২০১২ সালের আইন অনুযায়ী সরকার একান্ত প্রয়োজনে সংরক্ষণ সম্প্রসারণ করতে পারে।
তা ছাড়া, এই পদ্ধতিগত আপত্তি কেন মৌলিক বলে গণ্য করা হবে? আদালতেরও রায় আছে যে প্রয়োজনবোধে সরকার উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ করতে পারে। তারও চেয়ে বড় কথা হল, পশ্চাৎপদ শ্রেণি সম্পর্কিত কমিশনের সিদ্ধান্ত আদালতে স্বীকৃত হবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? আদালত বলতে পারে, জাতি জনগণনা অসম্পূর্ণ, তা যথেষ্ট হয়নি। বলতে পারে, নমুনা সংগ্রহ ও সমীক্ষার ভিত্তি দুর্বল। সম্পূর্ণ জাতি জনগণনা হলেই যে অন্যান্য পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর দেশব্যাপী বা রাজ্যব্যাপী মানচিত্র স্পষ্ট হবে,
তারই বা গ্যারান্টি কী? কে বলতে পারে যে ওই জনগণনা নতুন দাবি বা রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেবে না?
মাননীয় হাই কোর্টের প্রতি আস্থা রেখেও বলতে হয়, এই নিদান একপেশে ও অসম্পূর্ণ মনে হওয়া অসঙ্গত নয়। পদ্ধতিগত ত্রুটির যুক্তিতে যে আপত্তি, তার পিছনে সামাজিক অসাম্য ও পশ্চাৎপদতার বাস্তবতা সম্পর্কে এক ধরনের সন্দেহ বা উদাসীনতা রয়েছে বলে মনে হয়। অথচ, বেসরকারি অর্থনীতিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, সর্বত্র পারদর্শিতার ও দক্ষতার বোলবোলা। এক বিচিত্র ধারণা বিরাজমান যে, সংরক্ষণের আঘাতে সমাজ পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু চুরি, ডাকাতি, শেয়ার বাজারের নয়ছয়, কর ফাঁকি— কোনও কিছুতে সমাজের এগিয়ে থাকা জাতির অবদান কম নয়।
মেধা নিয়ে চিন্তা শাসকদের পাগল করে দেয়। অত্যুৎকৃষ্ট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চপ্রযুক্তি, উচ্চ ম্যানেজমেন্টের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে আর চালাতে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যস্ত থাকে। সাধারণ সমাজের পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? মণ্ডল কমিশন ১৯৩১ সালের জনগণনাকে ভিত্তি করে অন্যান্য পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই প্রস্তাবের বাস্তব তথ্য ভিত্তি ছিল স্বল্পসংখ্যক গ্রাম ও ব্লকের চেহারা। এই বার কলকাতার উচ্চ আদালত সাচার কমিটির যে রিপোর্টকে পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেছে, তার ভিত্তি ২০০৬ এবং তার আগের পরিসংখ্যান। তা হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্টকে ২০১২ সালে কী ভাবে ব্যবহার করতে পারত? ২০১২-তে তো রিপোর্টই বেরোয়নি। এবং ২০২১ সালেও জনগণনা হয়নি। জনগণনাতে তবে কী ভাবে এর সমাধান হতে পারত?
মুসলমান সমাজের কিছু পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী মণ্ডল কমিশনের রোয়েদাদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। পটনা হাই কোর্ট বলেছে, আনুপাতিক হারে সংরক্ষণ সংবিধানের সমানাধিকারের ধারাগুলির বিরোধী। কাজেই ৬৫ শতাংশ সংরক্ষণ চলবে না। ৫০ শতাংশের নীচে তা থাকতে হবে। অথচ, সংবিধানের অন্যত্র আনুপাতিক হারে সংরক্ষণের কথা বলা আছে। এই কচকচির শেষ নেই। ‘টেস্ট অব ফেয়ারনেস’ হল আইনসর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, এতে আইনি বিচার হয়, আইনসর্বস্ব ফয়সালা হয়। কিন্তু সামাজিক ন্যায় অধরা থেকে যায়।
পনেরো বছরেরও কিছু আগে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ থেকে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সংরক্ষণ ব্যবস্থার একটা মানচিত্র দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে নানা বিচারবিভাগীয় রায়ের এবং প্রশাসনিক নিদানের বহুত্ব উঠে এসেছিল। এই বৈচিত্রকে অস্বীকার করে, খণ্ডন করে, সংরক্ষণকে এক দড়িতে বাঁধার দরকার কী? কতটা সাম্য এতে অর্জিত হবে? সংরক্ষণকে কেন পশ্চাৎপদতার ভিত্তির পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে দেখা হবে? এ কেমন ন্যায়বিচার?
বিচারবিভাগের একাধিক রায় সামাজিক ন্যায়কে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। প্রথমেই পশ্চাৎপদতার ঐতিহাসিক চরিত্রকে স্বীকার করা জরুরি। জরুরি স্বীকার করা যে, পুরনো অসাম্য ও পশ্চাৎপদতার পাশাপাশি নতুন অসাম্য ও পশ্চাৎপদতার সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই পশ্চাৎপদতাকে দূর করা বা কমানোর জন্য রাষ্ট্রপ্রদত্ত অঙ্গীকার বা গ্যারান্টি। তৃতীয়ত, যে উপায়, প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থায় পশ্চাৎপদতা দূরীকরণ চলবে, তার স্থায়িত্বের গ্যারান্টি। এবং শেষ কথা, এই উপায়, প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থায় যৌথ অংশীদারি বা অভিভাবকত্ব। অর্থাৎ, পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে এই প্রক্রিয়ায়।
সুযোগের সমসৃষ্টি ও সমসদ্ব্যবহারের জন্য কমিশন সংক্রান্ত বিচারপতি সাচারের প্রস্তাবের গভীরতা আমরা যথেষ্ট উপলব্ধি করিনি। দেশব্যাপী বৈচিত্রের কথাও আমাদের খেয়ালে থাকেনি। তাই বিচারনীতি প্রায় দণ্ডনীতি হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক ন্যায়স্থাপন হয়ে যায় গৌণ। আইন দিয়ে, ও আইনানুগ বিচারনীতি দিয়ে সামাজিক পশ্চাৎপদতাকে কাটানোর জন্য যে নীতির আশা করা গিয়েছিল, তা পাওয়া যায়নি। বরং, সংবেদনশীলতা ও আলাপচারিতার অনুপস্থিতিতে সেই কাজ সমানে ব্যাহত হয়েছে। ‘ইকুয়াল অপরচুনিটি কমিশন’ আজ সরকারি দৃষ্টিতে সংখ্যালঘু উন্নয়নের বিষয় হয়ে গেছে। অথচ, সামাজিক বৈষম্য ও পশ্চাৎপদতা দূরীকরণ এবং সংখ্যালঘু উন্নয়ন বা সুরক্ষা— এই দু’টি বিষয় এক নয়। বিচারপতি সাচার মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের প্রয়োজনের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন। আইনবোধ এবং সামাজিক সংবেদনশীলতা ছিল তাঁর রিপোর্টে। সেই রিপোর্টের মূল দার্শনিক ভিত্তি ছিল, ন্যায়ের সদর্থক সংজ্ঞা হয় না। সদর্থক সংজ্ঞা দিতে গেলে ন্যায়বিচার কুতর্কে পর্যবসিত হয়। পশ্চাৎপদতাকে চিহ্নিত করা ও অপনোদনের চেষ্টাই হল ন্যায় প্রতিষ্ঠার শুরু। সেই চেষ্টা যত চলবে, ততই সমাজ তার ন্যায়ের সংজ্ঞা তৈরি করতে পারবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy