অনেক দেশেই সরকার প্রবীণদের সামাজিক সুরক্ষা, চিকিৎসা, সসম্মানে বেঁচে থাকার সুব্যবস্থা করে। ভারতেও তা আছে। জওহরলাল নেহরু সরকারি কর্মচারীদের জন্যে অবসরকালীন ভাতা বা পেনশন চালু করেন। পরে সামাজিক সুরক্ষার পরিধি আরও বাড়িয়ে ‘ফ্যামিলি পেনশন’ চালু হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ও তাঁদের পরিবারের স্বাস্থ্য রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা রয়েছে, পারিবারিক ও সামাজিক হেনস্থা থেকে রক্ষার জন্যে হয়েছে একাধিক আইন। পেনশনের সুবিধা সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে দিতে ২০০৪-এ চালু হয়েছে জাতীয় পেনশন প্রকল্প, ২০১৮ সালে বয়স্কদের জন্যে স্বাস্থ্য বিমা ‘আয়ুষ্মান ভারত’।
তবে খামতিও আছে অনেক। কোভিডকালে সবাই যখন আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, কেন্দ্রীয় সরকার তখন এমন একাধিক আর্থিক ব্যবস্থা নেয় যা সাধারণ মানুষের ভাল থাকার পরিপন্থী। সরকার কাঁচা খাদ্যসামগ্রী দিলেও, অন্য দিকে আর্থিক সাহায্যের পরিবর্তে ঋণের বোঝা চাপাতে চেষ্টা করে। কোষাগারে আর্থিক টানাটানির বাহানায় কয়েকটা সুরক্ষা প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মচারী ও পেনশনারদের ২০২০-র জানুয়ারি-পরবর্তী তিনটে কিস্তির মহার্ঘভাতা বৃদ্ধিও। এতে সরকারের প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এই সময় ঘরে ঘরে প্রবীণদের চিকিৎসার বিপুল খরচ সামাল দিতে বহু মানুষকে সঞ্চিত পুঁজিতে হাত দিতে হয়েছে, কারণ তাঁদের জন্যে সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না, বেসরকারি হাসপাতালগুলো পরিষেবা দিয়েছে অত্যধিক টাকার বিনিময়ে। বয়সজনিত নানাবিধ অসুস্থতা ও কো-মর্বিডিটি থাকার কারণে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই চিকিৎসায় প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। দূরপাল্লার ট্রেনে প্রবীণদের সংরক্ষিত টিকিটে ছাড়ের ব্যবস্থা এক অর্থে সামাজিক সুরক্ষারই অংশ, প্রবীণদের কিয়দংশই এই সুবিধা গ্রহণ করেন। কোভিডকালে এই ছাড় প্রত্যাহার করা হল। অতিমারির পরে দূরপাল্লার ট্রেনে সংরক্ষিত শ্রেণিতে ৭.৩১ কোটি প্রবীণ মানুষ যাত্রা করেছেন। সম্প্রতি জানা গেল, ভাড়ায় ছাড় তুলে দিয়ে ২০২০-র মার্চ থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ১৫০০ কোটি টাকা!
কাজ থেকে হঠাৎ অবসর প্রবীণদের নিঃসঙ্গ করে দেয়। অনেকে একা থাকেন, তাতে মানসিক অবসাদের সম্ভাবনা থাকে। করোনায় এই পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে। প্রায় ঘরবন্দি থাকায় প্রবীণদের একাকিত্ব ও অবসাদ বাড়ে, মানসিক স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, লকডাউনে প্রবীণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। সমগ্র প্রবীণ জনসংখ্যার প্রায় ত্রিশ শতাংশ শহরাঞ্চলে, এবং সাড়ে পাঁচ কোটি দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। ৬ শতাংশ প্রবীণ কোনও না কোনও কারণে একা, ২০ শতাংশ একাকিত্বের শিকার। ভারতে প্রবীণদের মধ্যে কোভিডকালে মানসিক অবসাদ ৪২ শতাংশ ও আত্মহননের মাত্রা ৩১ শতাংশ বেড়েছে। জীবন অনেক স্বাভাবিক হলেও এখনও অনেকের মনে অবসাদ। একা থাকা প্রবীণদের হঠাৎ গুরুতর অসুস্থতা, হৃদ্রোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ঘরে পড়ে থেকে মৃত্যুর ঘটনা শোনা যাচ্ছে প্রায়ই।
কয়েকটি প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও সেগুলির যথার্থ রূপায়ণের অভাব প্রবীণদের প্রতি সরকারি অবহেলারই বার্তাবহ। একমাত্র আয়ের উৎস আমানতে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সাময়িক মহার্ঘভাতা বন্ধ, সংরক্ষিত টিকিটে ছাড় তুলে দেওয়া তারই নিদর্শন। এই সামাজিক সুরক্ষাগুলি প্রত্যাহার করে যে আর্থিক লাভ হল সেটা কি ‘আয়’ বলে ধরা যায়? এ তো এক ধরনের প্রতারণা। আরও উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং প্রথায় অনেক প্রবীণই সড়গড় নন, অনেকেই প্রভূত টাকা খুইয়েছেন। সরকারি যাবতীয় অনুদান ব্যাঙ্কে সরাসরি জমা পড়বে, তাই এক সময় শূন্য সঞ্চয় ব্যবস্থা করে খাতা খোলা হল। টাকা জমা পড়তে লাগল। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ ব্যাঙ্কের আমানতে শূন্য সঞ্চয় সুবিধা তুলে নিল। প্রতি মাসে হাজার হাজার বৃদ্ধ ও দরিদ্রের খাতায় টাকা জমা হওয়া মাত্র নির্দিষ্ট টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্কে গেলে শুনতে হয়, সর্বনিম্ন ব্যালান্সটুকুও নেই বলে টাকা কাটা গিয়েছে। এও তো এক ধরনের বঞ্চনা। পাশাপাশি বাড়ছে সাইবার প্রতারণাও। স্পেনে পার্কিনসন’স রোগে আক্রান্ত এক অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক সম্প্রতি দেশের সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যাঙ্কিং চালু করার ‘বিরুদ্ধে’ প্রচার শুরু করেছেন। তাঁর পক্ষে এটিএম-এ গিয়ে টাকা তোলা সম্ভব হয় না। অথচ, ব্যাঙ্ক তার শাখা বন্ধ করে উপভোক্তাকে অনলাইন পরিষেবা নিতে বাধ্য করছে। বয়স্ক, অশক্ত লোকের সংখ্যা ভারতেও অনেক। ব্যাঙ্কে কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়ে ডিজিটাল প্রথা বাধ্য করায় প্রবীণরা প্রচুর আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন, আইনের অপব্যবহারে তাঁদের প্রতিবাদ ভাষা পাচ্ছে না। সরকার মেতে আছে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে, প্রবীণদের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা তার কাছে বাতুলতা মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy