বৈঠকখানা বাজারের ছায়ান্ধকার এলাকায় একটা ঘুপচি ঘর। সেখানেই ডেকেছিলেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ। একটু গোপনে। একটু আড়ালে। একটু আবডালে। খবর দেবেন। রাজ্য রাজনীতিতে তখন তিনি টগবগে ‘আইটেম’। বিদ্রোহী। সিপিএম ভেঙে বেরিয়ে নতুন দল গড়বেন। সেই তিনি যখন বিশেষ দূতের মারফত খবর দিচ্ছেন, না যায় কোন আহাম্মক!
খর দুপুরেও আলো না-ঢোকা সেই চিলতে ঘরের প্রাচীন টেবিলের উপর রাখা দড়ি-বাঁধা একটি পিচবোর্ডের ফাইল। সেটির ভিতর থেকে কিছু নথিপত্র বার করে দেখিয়েছিলেন সমীর পুততুন্ডের ঘনিষ্ঠ নেতা। সমীরের তখনকার দল সিপিএমের দুর্নীতির নথিবদ্ধ প্রমাণ। খবর হয়েছিল। পেজ ওয়ান।
তার কিছু দিন পরে এক সকালে সল্টলেকের বাড়িতে ডাকলেন আর এক বিদ্রোহী সুভাষ চক্রবর্তী। অফ দ্য রেকর্ড বললেন, সিপিএম ছাড়ছেনই। সব ফাইনাল। ‘অন কোট’ অতটা খোলাখুলি বললেন না। তবে বললেন, নতুন দলের নামের সঙ্গে ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটাও রাখবেন না! ওই শব্দটাকে আর লোকে বিশ্বাস করে না। আর কী চাই! ড্যাং-ড্যাং করে নাচতে নাচতে অফিসে গিয়ে কপি ফাইল করলাম। পেজ ওয়ান। সুপারলিড।
পরবর্তী কালে সমীর-সুভাষের বিদ্রোহের পরিণতি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের মহাফেজখানায় সযত্নে তোলা আছে। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৈফুদ্দিন চৌধুরী এবং সমীরের প্রতিষ্ঠিত পিডিএস সেই বছরের বিধানসভা ভোটে মোট ৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। কেউ জেতেননি। নবগঠিত দলটি মোট ভোট পেয়েছিল ২,১৯,০৮২টি। অর্থাৎ সারা রাজ্যের মোট ভোটের ০.৬ শতাংশ। পরবর্তী কালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে সমীর এবং তাঁর স্ত্রী অনুরাধাকে নিয়মিত দেখা যেত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্না এবং বিক্ষোভ মঞ্চে। কিন্তু সেই ফ্রেম থেকেও এখন তাঁরা বিলীন। দুরারোগ্য অসুখে ভুগতে ভুগতে ২০১৪ সালে ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন সৈফুদ্দিন। পিডিএস খানিকটা অনাথ হয়েছে বৈকি! সমীর-অনুরাধার বিদ্রোহ বাংলার রাজনীতিতে কোনও তুফান তুলতে পারেনি। তবে তাঁরা আপস করেননি। এখন কষ্টেসৃষ্টে প্রান্তিক রাজনীতি করেন।
সুভাষ শেষযাত্রায় গিয়েছিলেন মরদেহের উপর সিপিএমের পতাকা নিয়েই। সল্টলেকের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শ্মশান পর্যন্ত মিছিল হয়েছিল। তখনও বেঁচে নবতিপর জ্যোতি বসু। সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনে যাঁর প্রতিটি জন্মদিনে যেতেন সুভাষ। সঙ্গে বিশাল প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হউক জয়।’ যাঁর কথায় সুভাষ শেষমেশ সিপিএম ছাড়েননি এবং বাকি জীবনটা সফি-সমীরের তুমুল ক্ষোভের কারণ (ঘনিষ্ঠমহলে যা প্রায় ক্রোধে পর্যবসিত— সুভাষ’দা গাছে তুলে মই কেড়ে নিয়েছিলেন) হয়ে বেঁচে থেকেছেন।
সমীর-সুভাষরা পারেননি। যতীন চক্রবর্তী পারেননি। প্রণব মুখোপাধ্যায় পারেননি। সুব্রত মুখোপাধ্যায় পারেননি। সোমেন মিত্র পারেননি। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি পারেননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পারেননি। আরও খানিকটা নীচের স্তরে গেলে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পারেননি। মুকুল রায় পারেননি। সব্যসাচী দত্ত পারেননি। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় পারেননি। প্রত্যেকেই দলের অন্দরে বিদ্রোহী হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস তা-ই বলে। প্রত্যেকেই ফিরে গিয়েছেন মূলস্রোতে। কেউ পুরনো দলে। কেউ ছেড়ে-আসা মন্ত্রিসভায়।
পেরেছেন মাত্র এক জন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস একাধিক বার ভেঙেছে। যার শুরু ১৯৪৮ সালে। যখন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ। ১৯৬৬ সালে আবার কংগ্রেস ভেঙে ‘বাংলা কংগ্রেস’ তৈরি করলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। মমতা ছাড়া তিনিই এক মাত্র নেতা, যিনি কংগ্রেস (বা প্রতিষ্ঠান) ভেঙে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। তিন তিন বার। কিন্তু প্রতি বারই স্বল্প মেয়াদে। প্রথম বার ন’মাস। দ্বিতীয় বার ১৩ মাস এবং তৃতীয় বার ৮৯ দিন! অজয়ের ইনিংস সেখানেই শেষ। পরের বিদ্রোহ প্রণবের। ১৯৮৬ সালে ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’ গড়েছিলেন প্রণব। ১৯৮৯ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায় তাঁর দল। মিশে যান তিনিও।
তার পরে রাজ্য কংগ্রেসের ভাঙন ১৯৯৮ সালে। মমতার হাত ধরে। যাঁকে প্রথমে কেউই খুব একটা পাত্তা দেননি। সোমেন ভেবেছিলেন, আপদ গেল! প্রিয়-সুব্রত ভেবেছিলেন, মমতা খানিকটা দূর যাবেন। কিন্তু তাঁদের টপকাতে পারবেন না।
সম্ভবত এক জন অন্য রকম ভেবেছিলেন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদা এক ঘরোয়া এবং রাজ্য কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত মেদুর আলোচনায় প্রণব বলেছিলেন, কংগ্রেস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মমতা অন্তত ৫ শতাংশ ভোট সুইং করিয়ে নিজের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার তুল্য উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গে তো দূরস্থান, সারা দেশেও বিশেষ নেই! বস্তুত, সেই নিরিখে সারা ভারতে মমতাই এক মাত্র ‘বিদ্রোহী’ নেত্রী, যিনি প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করে নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়েছেন এবং যাঁর হাতে টানা ১৫ বছরের জনাদেশ রয়েছে।
প্রবীণ রাজনীতিকরা মনে করেন, ১৯৯০ সালের ১৬ অগস্ট হাজরা মোড়ে মার খাওয়াই মমতার উত্থান এবং রাজ্যে বামবিরোধী আন্দোলনের ‘মুখ’ হিসেবে কংগ্রেসের অন্দরে তাঁর স্বীকৃতি পাওয়ার শুরু। ওই ঘটনার পর সুস্থ হয়ে উঠে মমতা প্রথম সভায় এসেছিলেন মাথায় কালো কাপড় বেঁধে। তার পর থেকে বিশ্বাসযোগ্যতার নিরিখে আর তাঁকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
বিদ্রোহ করতে গেলে পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়। মমতা যেমন একটার পর একটা ব্রিগেড শুরু করেছিলেন। যার প্রতিটাই সফল। ঘটনাচক্রে, তিনি যাঁদের সঙ্গে পেয়েছিলেন, তাঁরাও সকলে মমতার ভাবনারই শরিক ছিলেন। ফলে কংগ্রেসের অন্দরে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে মমতা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৯৭ সালে নেতাজি ইন্ডোরে কংগ্রেসের প্লেনারি সেশনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ময়দানের গাঁধীমূর্তির পাদদেশে ‘আউটডোর’ সমাবেশ করেছিলেন বিদ্রোহী মমতা। কংগ্রেস তাঁকে বহিষ্কার করে। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার পর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে (তার মধ্যে বেশির ভাগই উতরাই। যেমন ২০০৪ সালে মাত্র এক জন সাংসদে নেমে আসা) ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতা থেকে সাড়ে তিন দশকের মৌরসিপাট্টা জমানো বামফ্রন্টকে সরিয়েছেন মমতা। তার পরে আরও দু’টি নির্বাচন জিতেছেন। আপাতদৃষ্টিতে সঙ্কট মনে হলেও ‘মমতা ম্যাজিক’ কাজ করে গিয়েছে মোক্ষম সময়ে। ২০১১ সালের চেয়ে ২০১৬ সালের ভোট কঠিন হয়েছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২১ সালের ভোট কঠিনতর। কিন্তু প্রতি বারই মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলের আসন বেড়েছে। ঘটনাচক্রে, এর মধ্যে ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল মমতার। পরের দু’টি নির্বাচনে তিনি একাই লড়েছেন। এবং দ্যাখ-দ্যাখ করে জিতেছেন। উল্টো দিকে বিরোধী শিবিরের সিপিএম এবং কংগ্রেস কমতে কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে!
সম্প্রতি বাংলার রাজনীতিতে এক ‘বিদ্রোহী’র উন্মেষ হওয়ায় ইতিহাস ফিরে ফিরে আসছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে যাঁরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে মমতাকে ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁরা কী কী বলেছিলেন। তার পরে কী কী গিলেছিলেন। এক মাত্র শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া আর সকলেই মমতার কাছে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ওহ্, ফেরেননি দীনেশ ত্রিবেদীও। নন্দীগ্রাম আসনে স্বয়ং মমতাকে হারিয়ে শুভেন্দু বিরোধী দলনেতা হয়েছেন। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, ততই তাঁর নিজের দুর্গে ফাঁকফোকর দেখা দিয়েছে। দিচ্ছে। আর প্রাক্তন বৈমানিক দীনেশ সম্ভবত এখন তুলনায় বেশি ব্যস্ত থাকেন সেই বিষয়টি নিয়ে, রাজনীতির অবসরে যে কাজটিতে তিনি সিদ্ধহস্ত— সেতারবাদন।
প্রিয়রঞ্জন আগেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। সোমেন নতুন দল গড়লেন। তাঁর দল তৃণমূলের সঙ্গে মিশে গেল। তার পর আবার তিনি জীবনের উপান্তে কংগ্রেসেই ফিরলেন। কলকাতার মেয়র হিসেবে সুব্রত পরিণতি, পরিকল্পনা এবং সাফল্যের ছাপ রাখলেন। বিদ্রোহী হয়ে পুরভোটে এনসিপি-র ‘ঘড়ি’ চিহ্নে দাঁড়ালেন। নিজে জিতলেন। কিন্তু দল জিতল না। তিনিও ফিরলেন তৃণমূলে। সুদীপ নির্দল হয়ে জোড়া মোমবাতি প্রতীকচিহ্ন নিয়ে দাঁড়ালেন। শোচনীয় ভাবে হারলেন। ফিরলেন তৃণমূলে। বুদ্ধদেব বিদ্রোহী হলেন। মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন। দল ছাড়লেন না যদিও। কালক্রমে ফিরেও এলেন। যে মন্ত্রিসভা ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেই মন্ত্রিসভারই মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
মমতাকে উৎখাত করার ব্রত নিয়ে মুকুল বিজেপিতে গেলেন। আবার ফিরলেন তৃণমূলে। রাজীব মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বিজেপিতে গেলেন। ভোটে হেরে ফিরেও এলেন। ছিলেন মন্ত্রী। ফিরলেন ত্রিপুরার দায়িত্ব নিয়ে। যেমন গেলেন এবং এলেন সব্যসাচীও। তফাত— গিয়েছিলেন সল্টলেকের মেয়র পদ ছেড়ে। ফিরতে হল কৃষ্ণা চক্রবর্তীর অধীনস্থ চেয়ারম্যান হয়ে।
ঘটনাগুলো রিওয়াইন্ড করে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, রাজনৈতিক জ্ঞানের বিকল্প বুদ্ধি হতে পারে না। রাজনৈতিক ধীশক্তি পরিমিতিবোধের শিক্ষা দেয়। বুদ্ধি দেয় চাতুর্য। বিবিধ বুদ্ধিমানেরা বিভিন্ন সময়ে ভেবেছিলেন বা ভাবছেন (তখন বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়ার সামনে আর এখন পার্থ চট্টোপাধ্যায় কাণ্ডে), মমতা খানিক দ’য়ে পড়েছেন। এখন তিনি রাজনৈতিক ভাবে ঈষৎ দুর্বল। এই হল তাঁর উপর একটু চাপ দিয়ে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার প্রকৃষ্টতম সময়। তাঁরা ঠিক ভাবেননি। তাঁরা রাজনীতির পরীক্ষিত সত্য বিস্মৃত হয়েছেন। ভুলে গিয়েছেন, রাজনীতিতে কৌশল ভাল। কিন্তু তার চেয়েও ভাল হল শাশ্বত হওয়া।
এঁদের প্রদক্ষিণ শুরু হয় নিজের থেকে। শেষও হয় নিজেরই কাছে। যাত্রা শুরু হয় নিজের বাঁ-হাত থেকে। শেষ হয় নিজেরই ডানহাতে। ফলে এঁরা পারিপার্শ্বিক দেখতে পান না। পাননি কোনওদিন। নিজের চারপাশে এমন একটা অদৃশ্য বলয় বানিয়ে ফেলেন যে, পরে হাঁসফাঁস লাগে। মনে হয়, কী দরকার ছিল!
অতীতের ঘটনাগুলোর সঙ্গে অতি সাম্প্রতিক ঘটনাটাকে এক সুতোয় বাঁধতে বাঁধতে মনে হয়েছিল, কেন যে এঁরা ‘জহর-ব্রত’ পালন করা কথা ভাবেন! শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু আয় দেয় না। গরিমার ব্রতকথা নিছক রোজকার পাঁচালিতে পর্যবসিত হয়!
পাদটীকা: ‘জহরব্রত’ হল রাজপুত নারীদের অগ্নিকুণ্ডে বা বিষপানে প্রাণবিসর্জন দেওয়ার ব্রত।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy